শনিবার   ০৮ নভেম্বর ২০২৫   কার্তিক ২৩ ১৪৩২   ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ইতিহাস গড়লেন মামদানি

হাসান মাহমুদ

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ১২:২৮ এএম, ৮ নভেম্বর ২০২৫ শনিবার



‘তিনি আসলেন, দেখলেন এবং সবকিছু জয় করলেন’। সম্মোহনি দুর্বার এক আকর্ষণে লাখ লাখ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিলেন অল্প কিছুদিনের মধ্যে। তারুণ্যের ছোঁয়ায় তিনি ইতিহাস গড়লেন নিউইয়র্কের ১১১তম প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়ে। অনন্য এই ঐতিহাসিক বিজয় জোহরান মামদানির জন্য অপেক্ষা করছিল। নিউইয়র্কের ইতিহাস লিখতে হলে মামদানির বিজয় ইতিহাস উঠে আসবে আগামী দিনে। ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী হিসেবে প্রাইমারীতে বিজয়ী হবার পর বিভিন্ন মহল থেকে আসা নানা প্রতিবন্ধকতা, হুমকি, অসহযোগিতা ডিঙ্গিয়ে জোহরান মামদানি (৩৪) এখন বিশ্বব্যাপি অত্যন্ত জনপ্রিয় এক মহানায়কের আসনে অধিষ্ঠিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা অপপ্রচার, মামদানির ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে নানা ট্রল করেও তাঁর ঐতিহাসিক বিজয় ঠেকানো যায়নি। ‘হেমিলনের বাঁশিওয়ালা’র মতোই মানুষ তাঁর ডাকে ঘর ছেড়ে, কাজ ছেড়ে ছুটে গেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন। ছাত্র, জনতা, পেশাজীবী এবং সাধারণ নিউইয়র্কবাসি নিজেদের ভালোবাসা উজার করে দিয়েছেন মামদানির জন্য। নিউইয়র্কের ইতিহাসে এবারই প্রথম আগাম ভোট পড়েছে ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭টি। জানা যায়, মোট ভোট পড়েছে ২০ লাখ। নির্বাচনে ৩৪ বছর বয়স্ক জোহরান মামদানি ৫০.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ি হয়েছেন। অন্যদিকে ৬৭ বছর বয়সী অ্যান্ড্রু কুমো অর্জন করেন ৪০.৬ শতাংশ ভোট এবং রিপাবলিকান স্লিওয়া পেয়েছেন ৭.১ শতাংশ ভোট। শুরুতে ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট মামদানিকে তাঁর দলে একজন প্রান্তিক পর্যায়ের প্রার্থী হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু নিউইয়র্কে প্রচলিত ধারার রাজনীতিবিদদের চিন্তাধারা, কথা, সিদ্ধান্ত তরুণ প্রজন্মের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছিল অনেক আগেই। তরুণ সমাজ নতুন কোন যাদুকরি ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন। অনেকটা হঠাৎ করেই মামদানির অবির্ভাব হলো। নানা ভাষায় পারদর্শি মামদানি ব্যতিক্রমভাবে কথা বলা শুরু করলেন। তিনি নগরবাসিকে ভালোবাসার ডাক দিলেন। নিজেদের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তোললেন। তাতেই তরুণ ভোটাররা এগিয়ে আসতে শুরু করে। ছোট ছোট আলোচনা অনুষ্ঠান সমাবেশে রূপ নিতে শুরু করলো। তাঁর মুসলিম পরিচয়, সততা ও নিষ্ঠার কারণে ভোটারদের কাছে আলাদা গুরুত্ব বহন করতে শুরু করছিল। অল্প দিনেই জোহরান মামদানি জাতীয় পর্যায়ের আলোচিত নেতা হিসেবে গণ্য হতে থাকেন। গত জুন মাসের দলীয় নির্বাচনে তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে বিজয়ী হয়ে অনেককে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেন।
মামদানি আশাবাদি ছিলেন- আগেরবারের মতো এবারও তরুণ ভোটাররা তাঁর পাশে থাকবেন। তবে শুধু নিউইয়র্কের মধ্যেই নয়, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মোকাবিলার তাঁর অঙ্গীকার পুরো দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও সাড়া ফেলেছে। অনেক জেনজি ও মিলেনিয়ালস প্রজন্মের মানুষ বলছেন, মামদানির জন্য তারা ছিলেন নিবেদিত। অন্য প্রার্থীরা এভাবে সাড়া জাগাতে পারেননি। নির্বাচনে তাঁর প্রচার প্রচারণা, মিডিয়া টিম ছিল অত্যন্ত সক্রিয়।
মামদানির প্রচারণায় প্রগতিশীল নেতারা যেমন সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ উচ্ছ্বসিতভাবে পাশে এসে, মঞ্চে উঠে জনতার সামনে সমর্থন দেন। শেষ দিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, হাউস সংখ্যালঘু নেতা হাকিম জেফ্রিজ এবং নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোকুল তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থী কুমো এক বার্তায় মামদানিকে অভিনন্দন জানান। ওইদিন রাতেই ব্রুকলিনে আয়োজিত এক বিজয় ভাষণে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যের ব্যাপারে রিতিমত পাল্টা জবাব দেন নবনির্বাচিত মামদানি। তাঁর ভাষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়।  মামদানি তাঁর এই জয়কে পরিবর্তনের ম্যান্ডেট হিসেবে ঘোষণা করেন। ব্রুকলিন প্যারামাউন্টে উপস্থিত সমর্থকদের মাঝে তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইঙ্গিত করে ভলিউম বাড়ানোর কথা বলে রীতিমতো চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। তাঁর এ বক্তব্যের পর পুরো এলাকা করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।
জোহরান মামদানি বিজয় সমাবেশে বলেন, আজ আমরা স্পষ্ট কণ্ঠে বলেছি, আশা বেঁচে আছে। এটি এমন এক যুগ হবে, যেখানে নিউইয়র্কের বাসিন্দারা তাদের নেতাদের কাছে আরও সাহসী ভূমিকা প্রত্যাশা করবেন। রাজনৈতিক অন্ধকারের এই মুহূর্তে, নিউইয়র্ক আলোর প্রদীপ হবে বলেও ভাষণে দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করেন মামদানি।
মামদানি বলেন, কোনো স্বৈরশাসককে হারানোর একমাত্র উপায় হলো সেই ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলা, যা তাকে ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেছে। মামদানির এ ভাষণ চলাকালীনই ট্রাম্প নিজের ট্রুথ সোশ্যাল অ্যাকাউন্টে লেখেন, ...এবং শুরু হলো! মেয়র নির্বাচিত হয়েই প্রথম ভাষণে মামদানি তাঁর প্রশাসনের এজেন্ডা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, তার প্রশাসন জমি ও বাড়ির মালিকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনবে, যারা নিউইয়র্কে স্বাচ্ছন্দ্যে ভাড়াটিয়াদের শোষণ করে চলেছেন। তিনি শ্রমিক ইউনিয়নের পাশে থাকার এবং তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন,‘ নিউইয়র্ক থাকবে অভিবাসীদের শহর হিসেবে।’ দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে মামদানি তাঁর প্রশাসন ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা যায়।