লন্ডনে শরিয়াহ আইন, ৭ যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে ট্রাম্পের দাবির ফ্যাক্ট-চেক
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:৪৪ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বৃহস্পতিবার

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গতকাল মঙ্গলবার প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে বক্তব্য দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্ব নেতাদের সামনে দেওয়া বক্তব্যের বেশ কয়েকটি প্রসঙ্গে তিনি ভুল, অসম্পূর্ণ ও অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়েছেন।
বক্তব্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প মিত্র দেশগুলোর সমালোচনার পাশাপাশি, প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ তোলেন। এমনকি জাতিসংঘের অস্তিত্ব থাকা উচিত না বলেও মন্তব্য করেন। ট্রাম্পের বক্তব্যের ৯টি প্রসঙ্গ ফ্যাক্ট-চেক করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
লন্ডনে শরিয়াহ আইন
বক্তব্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি লন্ডনে দেখেছি, সেখানে খুবই ভয়ংকর একজন মেয়র আছেন। সেখানে অনেক কিছু বদলে গেছে। এখন তারা শরিয়াহ আইন চালু করতে চায়।’
বর্তমানে লন্ডনের মেয়র সাদিক খান। শহরটির তিনিই প্রথম মুসলিম মেয়র। নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। লন্ডনে সাদিক খান শরিয়াহ আইন প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। যুক্তরাজ্য সরকারের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮০ সাল থেকে শরিয়াহ কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন আছে। তবে সেটি ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি। এর কোনো সরকারি কিংবা সাংবিধানিক ভূমিকা নেই। অপরদিকে মেয়র হওয়ার পর থেকেই ইসলামকে ভয় পায় এমন ব্যক্তিদের দ্বারা সাদিক খান আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
বিভিন্ন সময় সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে, সাদিক খান শরিয়াহ আইন চালুর বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখছেন। লন্ডনে তিনি মদ বিক্রি নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছেন বলেও সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট ভাইরাল হয়। এসব বিষয়কে প্রতিবারই গুজব বলেছেন সাদিক।
ট্রাম্পের গতকালের বক্তব্য সম্পর্কে সাদিক খানের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা তাঁর নিন্দনীয় ও পক্ষপাতদুষ্ট বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাই না।’
সাতটি যুদ্ধ বন্ধ
বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, ‘জাতিসংঘের আসলে কাজ কী? তারা কেবল কড়া ভাষায় চিঠি লেখে। কিন্তু সেই চিঠির নির্দেশ কেউ অনুসরণ করে না। যে কাজ জাতিসংঘের করা দরকার তা আমাকে করতে হচ্ছে। যেসব যুদ্ধ শেষ হওয়ারই কথা না, আমিই এমন সাতটি যুদ্ধ বন্ধ করেছি।’
নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ট্রাম্প বক্তব্যে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া, কঙ্গো-রুয়ান্ডা, ভারত-পাকিস্তান, ইরান-ইসরায়েল, থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া, মিশর-ইথিওপিয়া এবং কসোভো-সার্বিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ বন্ধের দাবি করেছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত আগস্টে ট্রাম্প আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার নেতাদের হোয়াইট হাউসে ডেকে এনে যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করিয়েছেন। এটা কোনো শাক্তি চুক্তি ছিল না। দুই দেশের নেতারা তখন ট্রাম্পের প্রশংসা করলেও নিজ দেশে ফিরে সংঘাত পুরোপুরি বন্ধ করেননি। আজারবাইজান এখনো বিতর্কিত নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল দাবি করছে। এমনকি তারা নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা বলে এখনো আর্মেনিয়ার কিছু ছোট এলাকা দখল করে রেখেছে। দুই দেশ এখনো একটি যৌথ সীমান্তের বিষয়ে একমত হতে পারেনি।
গত জুনে কঙ্গো-রুয়ান্ডার নেতারা হোয়াইট হাউসে গিয়ে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও এখনো প্রাণঘাতি সহিংসতা অব্যাহত আছে। অপরদিকে ভারত-পাকিস্তান উভয়ই সংঘাত বন্ধে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার কথা স্বীকার করছে। তবে ভারত এটিও বলেছে যে, সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করেই সংঘাত বন্ধ করা হয়েছে। কারণ, ভারতীয় সেনাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানই প্রথম সংঘাত বন্ধের প্রস্তাব দেয়।
ইরান-ইসরায়েলের ক্ষেত্রে সংঘাত সাময়িক বন্ধ হলেও এখনো উভয়পক্ষ একে অপরকে হুমকি দিচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে কতদিন শান্তি বিরাজ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার সংঘাত বন্ধের জন্য ট্রাম্প উভয় দেশের নেতাদের হুমকি দিয়েছিলেন। বলেছেন, তাঁর কথা না শুনলে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবেন। সমালোচকরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি সংঘাত বন্ধ হলেও সীমান্ত নিয়ে মূল সমস্যার সমাধান হয়নি।
ট্রাম্প মিশর ও ইথিওপিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বন্ধের কথা বললেও এই দুই দেশের কোনো সামরিক সংঘাত ছিল না। নীল নদে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে কূটনৈতিক বিরোধ সংঘাতে রূপ নিতে পারতো বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। সেখানেও ট্রাম্পের কূটনৈতিক চেষ্টা তেমন কাজে আসেনি। ইথিওপিয়া বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ করেছে। চলতি মাসেই এটি উদ্বোধন হওয়ার কথা। অন্যদিকে মিশর ও সুদান এখনো এই বাঁধের বিরোধীতা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর বক্তব্যে কসোভো ও সার্বিয়ার প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন। এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৯৮-৯৯ সালে। তখন ন্যাটোর হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বন্ধ হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশ কসোভোর স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু সার্বিয়া তখন এমন সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে। সার্বিয়ার মিত্র রাশিয়া ও চীনও কসোভোকে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি।
এই দুই দেশের মধ্যে এখনো কোনো শান্তি চুক্তি হয়নি। ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে সার্বিয়া-কসোভোর মধ্যে যে চুক্তি করিয়েছিলেন সেটি ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়া সম্পর্কিত।
প্রসঙ্গ চীন
বক্তব্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আমি চীনকে অনেক কৃতিত্ব দিই। তারা উইন্ড টারবাইন (বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা) বানায়। কিন্তু তাদের দেশে খুব কমই উইন্ড ফার্ম আছে। জানেন কী, তারা কয়লা ব্যবহার করে, গ্যাস ব্যবহার করে, প্রায় সবকিছু ব্যবহার করে, কিন্তু বাতাসের শক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন পছন্দ করে না।’
ট্রাম্প তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে চীনকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করতে চেয়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, চীন অনেক বেশি উইন্ড টারবাইন রপ্তানি করে এ কথা সত্য। কিন্তু তারা অনেক বেশি ব্যবহারও করে।
জার্মানভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড উইন্ড এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন’-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে বাতাস থেকে উৎপাদিত শক্তি ব্যবহার হয় প্রায় ১২ লাখ মেগাওয়াটস। এর মধ্যে চীনই ব্যবহার করে ৫ লাখ ৬১ হাজার মেগাওয়াটস।
অন্যান্য দাবি
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে বাইডেন প্রশাসনের সময় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের কম বিনিয়োগ পাওয়ার দাবি করেছেন। বলেছেন, একই প্রশাসনের সময় প্রায় ৩ লাখ শিশু নিখোঁজ হয়েছে।
ট্রাম্প বলেছেন, মার্কিনিদের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল নিয়মিত কমছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগার ও মানসিক ইনস্টিটিউশনে থাকা লাখো মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছে। ওয়াশিংটন ডিসিই হলো যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধের রাজধানী। গত এক বছরে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবনের কারণে ৩ লাখ (আসলে ৮০ হাজার) মার্কিন নাগরিক মারা গেছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এসব দাবির কোনো প্রমাণ নেই। কিছু সংখ্যা তিনি অতিরিঞ্জিত করে বলেছেন।
(নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রতিবেদনটি লিখেছেন লিন্ড চিউ।