শনিবার   ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৪ ১৪৩২   ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জামাত কেন এবারই ক্ষমতায় যেতে চায়!

সাঈদ তারেক

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৪০ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার

মন্তব্য প্রতিবেদন

 
 
 

তারা কি মনে করছে দিস ইজ দ্য টাইম! এখনই সময়! বা এইবারই শেষ সময়! বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্ধি ছিল আওয়ামী লীগ। তারা মাঠছাড়া। এই চামে জায়গাটা নিয়ে নেওয়া! টার্গেটটা কি বিএনপিকে হঠিয়ে এইবারই ক্ষমতায় যাওয়া!
এক বছর ধরে বিএনপির বিরুদ্ধে   প্রচারণার শেষ নাই। পরিকল্পিত এবং সংঘবদ্ধ প্রপাগান্ডা। কারা করছে সবাই জানে। বিএনপি কেন প্রেসিডেন্টকে সরাতে সায় দিলো না, কেন জেনারেল ওয়াকারকে তাড়ালো না, কেন এখনই নির্বাচন চায়, কেন ইউনূস সাহেবকে অন্তত: বছরপাঁচেক থাকতে দিলো না, ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাটের জন্য অধৈর্য হয়ে উঠেছে। আরও কত কি! এর আগে বলা হয়েছে ১৭ বছরের বুভুক্ষ, সামান্য বালির ট্রাক সড়াতে পারে নাই, যেহেতু নির্বাচন চায় তারা ফ্যাসীবাদের দোসর, ভারতের দালাল! এখন সংষ্কার বা পিআর ছাড়া নির্বাচন চায়- তার অর্থ ক্ষমতায় গিয়ে স্বৈরাচার কায়েম করবে! এইসব পরিকল্পিত প্রপাগান্ডার একটাই উদ্দেশ্য- বিএনপিকে পঁচানো, দলটা সম্পর্কে মানুষকে বিষিয়ে তোলা! যাতে সামনের নির্বাচনে মানুষ তাদেরকে ভোট না দেয়।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশের মত আমাদের দেশেও প্রধানত: দ্বি-দলীয় ব্যবস্থাই। সেই পাকিস্তান আমল থেকে। তখন অনেক দলই ছিল কিন্তু মূল প্রতিদ্বন্ধি থাকতো মুসলিম লীগ আর আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ)। স্বাধীনতার আগ দিয়ে উদ্ভব হয়েছিল মি: ভুট্টোর পিপলস পার্টি যা অনেকটা পাকিস্তানের এক অংশের দল হিসেবে পরিগনিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর অনেক দল থাকলেও মূল  প্রতিদ্বন্ধি ছিল আওয়ামী লীগ আর জাসদ। জিয়াউর রহমান জাসদের দফা রফা করে দিলে ’৭৯এর নির্বাচনে আবার উঠে আসে আওয়ামী লীগ। ৩৯টা আসনে জিতে সংসদে তারা প্রধান বিরোধী দল হয়। এরশাদ সাহেব জাতীয় পার্টি গঠন করলে রাজনীতি গড়ায় ত্রিদলীয় আবর্তে। এই অবস্থা ছিল বছর পাঁচেকের জন্য। ’৯১ থেকে আবার বিএনপি আর আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টির তেইশ মেরে দেয় শেখ হাসিনা। না হলে আজ আওয়ামী লীগের জায়গাটা তারা নিতে পারতো।
জামাত কখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাওয়ার কন্টেন্ডার ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতায় বিরোধীতার কারনে স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ ছিল। জিয়াউর রহমান রাজনীতি করার সুযোগ দিলেও কখনও স্পেস দেন নাই। মূলত: এরশাদ শাসনকালে হাটি হাটি পা পা করে যাত্রা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ বিএনপির তাদেরকে প্রয়োজন হয়।
লাইমলাইটে আসে। ’৯১এর নির্বাচনে ১৮টা সীট পাওয়া এবং তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সাথে আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় দলটা একটা শক্তি হিসেবে প্রমান দেয়। এই সুবাদে ’২০০১এ বেগম জিয়ার সরকারে দুইটা মন্ত্রীত্ব লাভ করে ইতিহাসে প্রথমবারের মত ক্ষমতার স্বাদ পায়। ১/১১এর পর থেকে আবার সাইড লাইনে।
মাঠে মুল খেলোয়ার ছিল দুইটা দল- আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। মানুষেরও ধারনা আওয়ামী লীগের পরে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, বিএনপি গেলে আওয়ামী লীগ। শেখ
হাসিনা ১৬ বছর সে সুযোগ দেয় নাই। এখন নিজে পালিয়েছে, আওয়ামী লীগকেও সাথে নিয়ে গেছে। ফলে মাঠ খালি। সরল হিসাবেই নির্বাচনে বিএনপি জিতবে। যদি সঠিক রাজনীতি করতো জাতীয় পার্টি নিতে পারতো আওয়ামী লীগের জায়গাটা, কিন্তু সাত ভাগে ভাগ হওয়া আর ১৬ বছর দেউলিয়া রাজনীতির কারনে এই দলটার নিজস্ব আবেদন বলতে খুবই কম।
জামাত একটা ধর্মভিত্তিক দল। ধর্মভিত্তিক কোন সংগঠন বা সম্প্রদায় কখনও জাতীয় রাজনৈতিক দল হতে পারে না। তাছাড়া জামাতকে অনেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে মানতেও নারাজ। কেউ কেউ এদেরকে বলতে চায় মুসলমানদের একটা পৃথক সম্প্রদায়।
ভিন্ন তরীকা ভিন্ন আকিদা। ইসমাইলী সম্প্রদায় বাহাই সম্প্রদায় কূর্দী সম্প্রদায় বা আহমদীয়া সম্প্রদায়ের মত একটা ভিন্ন সম্প্রদায়। মওদুদীয়া সম্প্রদায়। ভিন্ন মজহাব। ইসলামপন্থীদের মধ্যেই জামাতের বিরোধীতা আছে। কেউ কেউ তাদেরকে প্রকৃত মুসলমান মানতেই নারাজ।
তারপরও জামাত দল হিসেবেই রাজনীতি করছে। এটা একটা আন্তর্জাতিক দল। বাংলাদেশে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ৫ আগস্টের পর থেকে সদর্পে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে সেকেন্ড পজিশনটা অটোমেটিক তাদের হয়ে গেছে। কিন্তু দলটা বিএনপির মত মহীরূহ দলকে টেক্কা দিয়ে এবারই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে গেছে কেন সেটাই প্রশ্ন!
রাজনীতিকরা দল করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, সে হিসেবে জামাতও চাইবে। ঠিক আছে।
কিন্তু এইবারই কেন! তাও বিএনপিকে ফেলে দিয়ে! তারা কি মনে করছে এবার মিস করলে ট্রেন আর আসবে না! বা ক্ষমতায় যেতেই হবে কেন! ইসলামি হুকুমত কায়েম করতে! কোন হুজুরের ভাষায় তালিবানি শাষন কায়েমের জন্য! পাকিস্তান সাংবিধানিকভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র। সে দেশের মুসলমানরা অনেক বেশী ধর্মপ্রাণ। তারপরও সেখানে কখনও কোন ইসলামপন্থী দল ক্ষমতায় যেতে পারে না। প্রতি নির্বাচনেই জামাত সীট পায় হাতেগোনা কয়েকটা করে। মানুষ তাদেরকে ভোট দেয় না। একমাত্র আফগানিস্তানে ইসলামি শাষনের নামে কিছু মধ্যযুগীয় বিধিবিধান আছে। এ ছাড়া দুনিয়ার কোন মুসলমানপ্রধান দেশে প্রকৃত ইসলামি শাসন নাই।
বাংলাদেশে ৮০ পার্সেন্ট মুসলমান আরবী ফার্সি নাম বা জন্মসূত্রে মুসলমান। ধর্মপ্রান কিন্তু ধর্মান্ধ না। ধর্মপ্রাণ বলতে এরা ধর্মকে অন্তরে লালন করে কার্যত: অধর্মীয় বা অনৈসলামিক কাজ করে। অনেকে আছে সারা রাত হুজুরের কাছে আইয়ুব নবী ইউসুফ নবীর কিচ্ছা শুনে কেঁদে বুক ভাসায়, সকালে বাড়ী এসে নাশতা দিতে দেরী হলে বউ পেটায়। হজ্ব করে এসে লম্বা সুন্নতি দাড়ি রাখে আবার মজুতদারি করে
রোজায় জিনিষের দাম বাড়ায়। বিসমিল্লাহ বলে ঘুষের টাকা গুনতে শুরু করে, হারামের
টাকা পকেটে ভরতে ভরতে জামাতে নামাজ ধরার জন্য মসজিদে ছোটে! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে না জুম্মায় গিয়ে লাইন দেয়। রোজা রাখার নাম নাই সন্ধ্যায় ইফতারির দোকানে গিয়ে হুমড়ি খায়! হারামের টাকায় সবচেয়ে বড় গরুটা কিনে এনে কোরবানী দেয়। ইসলামের নামে সবচেয়ে বড় ধোকাবাজী বা মোনাফেকিটা এই বাংলাদেশের তথাকথিত নামধারী মুসলমানের মধ্যেই দেখা যায়। এরা পীর ফকির মানে। পীরের কাছে বায়েত নেয় মাজারে গিয়ে সিন্নি দেয়। ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে মন দিয়ে হুজুরের বয়ান শুনে, ফিরে এসে মিথ্যা কথা বলে, অন্যকে ঠকায়। এটাই এখানকার সংষ্কৃতি। এনরকম একটা মুসলমানের দেশে মানুষকে না বদলিয়ে, মানসিকভাবে প্রস্তুত না করে ইসলামি শাষন কিভাবে কায়েম হবে আমার বুঝে আসে না! জবরদস্তি চাপিয়ে দিয়ে! বন্দুকের নলের মুখে! হুজুররা যদি মনে করেন মেরে পিটিয়ে এই দেশে ইসলামি শাষন কায়েম করবেন, বুঝতে হবে তারা এখনও রাজনীতির বাল্যশিক্ষার পাঠশালাতেই রয়ে গেছেন।
জামাত বা ইসলামি দলগুলোকে বাস্তবতা বুঝতে হবে। খামাখা বাগড়া না দিয়ে সময়মত নির্বাচনটা হতে দিতে হবে। বিএনপি যদি জেতে, ক্ষমতায় তাদেরকে মেনে নিতে হবে। জনমত গঠনে সরকারি ক্ষমতার ব্যবহারের চাইতে বিরোধী দলে গিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম বেশী কার্যকর, এটাই রাজনীতির শিক্ষা। এ শিক্ষাটা যদি তারা গ্রহন করেন, বুদ্ধিমানের কাজ করবেন। বেশী বাড়তে গেলে হঠাৎ করে পড়ে যেতে হবে! আবার! এবার ঠ্যাং ভাঙলে মেরামত করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে! বা সে সময় আর নাও আসতে পারে!