বৃহস্পতিবার   ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ২ ১৪৩২   ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ট্রাম্পের ‘ল্যাসে-ফেয়ার’ অবস্থানই নেতানিয়াহুকে বেপরোয়া করছে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:১১ এএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বৃহস্পতিবার

গাজা সিটিতে গতকাল মঙ্গলবার থেকে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। এতে একদিনেই নিহত হন ৭০ জনের বেশি। এ অবস্থায়ও নিজেকে শান্তির দূত দাবি করা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নীরবতা পালন করছেন। এটিকেই নেতানিয়াহু প্রশাসন যেন সবুজ সংকেত হিসেবে ধরে নিয়েছে।

 

ইসরায়েলের এই অভিযান শুরুর ঘোষণা দেওয়ার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প তেল আবিবকে সংযমের আহ্বানও জানাননি, আবার পদক্ষেপকে সমর্থন করেও কিছু বলেননি। নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিবেচনায় এটি একটি ‘ল্যাসে ফেয়ার’ অবস্থান। ফ্রেঞ্জ বাক্যাংশ ‘ল্যাসে ফেয়ার’ এর অর্থ কেউ যা চায় তাকে তা করতে দেওয়া। গাজার বিষয়ে ট্রাম্প যেন এমন নীতিই নিয়েছেন যে, যা হওয়ার হবে।

 

ইসরায়েল গাজায় নতুন করে অভিযান শুরুর আগে বিশ্বের কয়েকটি বড় দেশের নেতারা সতর্ক করেছিলেন, এতে বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানির পাশাপাশি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে। কিন্তু ট্রাম্প তখনও নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের বাইরে ট্রাম্প বলেন, তিনি এ বিষয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি।

 

ট্রাম্পকে যখন সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেন, তিনি আক্রমণকে সমর্থন করেন কিনা, তখন প্রেসিডেন্টের উত্তর ছিল, ‘আচ্ছা, আমাকে দেখতে হবে। আমি এ বিষয়ে খুব বেশি জানি না।’

 

সবুজ সংকেত

 

নিজেকে বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তুলে ধরে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় দুই বছর ধরে চলা গাজা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। আগে তিনি ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সংঘাত বন্ধের চাপ দিতেন। তবে এখন সংঘাত বাড়তে থাকলেও তিনি তা নির্লিপ্তভাবে দেখে যাচ্ছেন।

 

যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সামরিক সহায়তা ইসরায়েলকে সংঘাত চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেবল একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টই পারেন নেতানিয়াহুর দৌঁড়ে লাগাম টানতে। কিন্তু ট্রাম্প তা না করায় নেতানিয়াহু লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটছেন।

 

জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় ইসরায়েলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যানিয়েল সি কার্টজার। তিনি বলছেন, ‘ট্রাম্প স্পষ্টতই যুদ্ধের অবসান ও জিম্মিদের মুক্তি চান। কিন্তু তাঁর কাছে নেতানিয়াহুকে চাপ দেওয়ার কোনো কৌশল নেই। তিনি হামাসকে হুমকি দেন, আর নেতানিয়াহু সেটিকে সবুজ সংকেত হিসেবে ধরে নেন।’

 

ড্যানিয়েল কার্টজার আরও বলেন, যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য একমাত্র ট্রাম্পই এখন ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু এ জন্য তাঁকে শুধু কথা না বলে কাজ করতে হবে।

 

চলতি বছরই একটি ইসরায়েলি সংবাদপত্রকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি নেতানিয়াহুকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আপনাকে যুদ্ধ শেষ করতে হবে। আপনাকে এটা শেষ করতেই হবে।’

 

ট্রাম্পের ওই মন্তব্যের পর মনে হয়েছিল তিনি হয়তো নেতানিয়াহুকে চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড যখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের ক্ষোভ চরমে তুলেছে, তখন আর ট্রাম্প কিছু বলছেন না। বরং তিনি এবার হামাসের সঙ্গে সমঝোতা হবে কি হবে না তা নিয়ে কথা বলেছেন। গত জুলাইয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় তারা (হামাস) মরতে চায়।’

 

ইসরায়েল পুরো গাজা দখল করতে পারে- এ নিয়ে গত মাসেও পশ্চিমা দেশের সরকার প্রধানরা উদ্বেগ জানিয়েছিলেন। কিন্ত ট্রাম্প তখন এ প্রসঙ্গে কেবল কাঁধ ঝাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি সত্যিই কিছু বলতে পারি না। এটা মোটামুটি ইসরায়েলের ওপরই নির্ভর করছে।’

 

বারাক ওবামা ও জো বাইডেন প্রশাসনে মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিশেষজ্ঞ ছিলেন ইলান গোল্ডেনবার্গ। তিনি বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের শুরুর দিকে মনে হয়েছিল যুদ্ধবিরতির চুক্তি এগিয়ে যাবে। ট্রাম্প নিজের প্রভাব খাটিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করবেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা ঘটেনি। বরং প্রতিটি ধাপে তিনি নেতানিয়াহুকে এক প্রকার ব্ল্যাংক বা খালি চেক দিয়েছেন।

 

চাপ দেওয়ার সময় এসেছে

 

ইসরায়েল নিয়ে ট্রাম্পের ‘ল্যাসে-ফেয়ার’ মনোভাব শিগগিরই নতুন পরীক্ষার মুখে পড়তে পারে। আগামী সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মিত্র- যেমন ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিনিকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে।

 

যদিও এমন পদক্ষেপ মূলত প্রতীকী, তবে তা ইসরায়েলকে বেশ ক্ষুব্ধ করছে। দেশটির ডানপন্থী নেতারা হুমকি দিচ্ছেন যে তারা পশ্চিম তীরের কিছু অংশ দখল করে নেবেন। এই দখল প্রক্রিয়াই ইসরায়েলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আরব প্রতিবেশীদের সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।

 

কারণ, ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে একটি চুক্তির মধ্যস্থতা করেছিলেন। যেটি ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে পরিচিত। চুক্তি করা দেশগুলো হলো- সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান। এই চুক্তির প্রতিশ্রুতি ছিল ইসরায়েল পশ্চিম তীরের একটি অংশ দখল করবে না। এই চুক্তিতে সৌদি আরবকেও যুক্ত করার কথা ছিল।

 

এখন ইসরায়েল যদি পশ্চিম তীরের বড় অংশ বা পুরোটা দখল করে নেয়, তাহলে ওই চুক্তি লঙ্ঘন হবে। পাশাপাশি সৌদি আরবের সঙ্গেও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। এ বিষয়টিই হয়তো শিগগিরই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করতে পারে। সেটি হলো- নেতানিয়াহুর ওপর চাপ দেওয়ার সময় এসে গেছে।