শনিবার   ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫   ভাদ্র ২৮ ১৪৩২   ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ডাকসু ইলেকশন মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড!

সাঈদ তারেক

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৭ এএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার

মন্তব্য প্রতিবেদন

 
 

না, শিরোনাম দেখে লেখাটাকে নিগেটিভলি নেওয়ার কিছু নাই। প্রফেসর ইউনূস যেমন বলেছিলেন শেখ হাসিনাকে তাড়াতে ছেলেরা মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, আমার কাছে মনে হয়েছে ডাকসুর নির্বাচনটাও ছিল তেমনই এক মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড অপারেশন। খুবই ভেবেচিন্তে হিসাব কিতাব কষে এই নির্বাচনের পরিকল্পনা করা হয়েছে, টাইমিং ঠিক করা হয়েছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ধাপগুলো সাজানো হয়েছে।
সোস্যাল মিডিয়ায় অনেককেই বলতে দেখলাম ৫ আগস্টের পর বিএনপি এবং এই দলের নেতাকর্মীদের নানা ধরনের দখলবাজিতে লিপ্ত হওয়ায় তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। তার প্রভাব পড়েছে এই নির্বাচনে। কথাটা একদম ফেলে দেওয়ার মত না। একটা মহল আছে স্বাধীনতা একাত্তুর বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললেই তাকে ভারতীয় বয়ান বলে ট্যাগ দেয়। ছাত্রদল জামাত শিবিরকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি বলায় নাকি সাধারন শিক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট হয়েছে। সেজন্য তারা ভোট পায় নাই। বাজে কথা। ছাত্রদল হেরেছে অন্য কারনে।
১। এটা তো এখন আর কোন রাখঢাকের ব্যাপার না যে ৫ আগস্টের পর পর জামাত এবং তাদের বাই-প্রডাক্ট শিশু দলটা প্রফেসর ইউনূসের ওপর ভীষনভাবে প্রভাব বিস্তার করে ক্ষমতার অঘোষিত অংশীদার হয়েছে। সেই প্রভাব কাজে লাগিয়ে জামাত যখন একেএকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দখল করছে, প্রশাসন পুলিশে নিজেদের লোক সেট করছে, আদালতে পছন্দের লোক বসিয়ে দিচ্ছে, বিটিভিসহ মিডিয়াগুলো নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নিচ্ছে- বিএনপি তখন হাট বাজার বাস স্ট্যান্ড টেম্পু স্ট্যান্ড ফুটপাথ হকারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির দখল নিচ্ছে! জামাত-শিবির রাজনীতি করেছে বিএনপি-ছাত্রদল দখলবাজি করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ঢাবির বর্তমান ভিসি একজন পুরনো শিবিরকর্মী বলে কেউ কেউ দাবী করেন। যদি তাই হয় শিবিরের প্রতি তার একটু ভিন্ন স্নেহদৃস্টি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে তার ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে জামাত যখন মূখ্য উদ্যোগটা নিয়েছিল!
২। মানুষ এখন জাতীয় নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। এই সময়ে হঠাৎ ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন কোন স্বাভাবিক ঘটনা মনে করার কারন নাই। জামাত যখন নিশ্চিত হয়েছে পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে এবং নির্বাচন দিলে শিবিরই পাশ করবে তখনই ভিসি সাহেবকে দিয়ে তড়িঘরি এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে- এমনও দাবী কারও কারও। জাতীয় নির্বাচনের আগে জামাত এই নির্বাচনে বিজয় দেশের মানুষের জন্য একটা বার্তা হিসেবে পাঠাতে চেয়েছে। সে কারনে কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ করে এই আয়োজন।
৩। শেখ হাসিনার সরকার বিএনপিকে নিয়ন্ত্রনে রাখার নীতি নিলেও জামাত শিবিরকে চেয়েছে নির্মূল নিশ্চিহ্ন করতে। দমন পীড়ন অত্যাচার নির্যাতনের হেন কোন তরীকা নাই যা পনেরো বছর তাদের ওপর চালানো হয় নাই। শিবিরের সাড়ে তিন শ’র ওপর নেতাকর্মীকে শুধু হত্যা করেছে, গুম করেছে অসংখ্য। আয়নাঘরে নিয়ে আটকে রেখেছে। পঙ্গু করে দিয়েছে। অনেকের শিক্ষাজীবন ধ্বংশ করে দিয়েছে। বাড়ী ঘরে থাকাও বন্ধ হয়ে যায়। জেল ঠাসা জামাত-শিবির নেতাকর্মীদের দিয়ে। হাজার হাজার মামলা, ওয়ারেন্ট। শীর্ষ নেতাদেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছে। বিএনপির নেতা কর্মীরা নির্যাতনের মুখে কোনমতে টিকে থাকলেও শিবির নেয় ভিন্ন পলিসি। তারা প্রকাশ্য কার্যক্রম বন্ধ করে পরিচয় গোপন রেখে ফিরে যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এবং কৌশলে ছাত্রলীগে ঠাঁই নেয়। এতে দুইটা লাভ হয়। পিঠ বাঁচে, লেখাপড়া চলে এবং সেই সাথে অতি সংগোপনে নতুন রিক্রুট মোটিভেশনসহ সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক অটুটই থাকে। ছাত্রলীগ পরিচয় দিয়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি করায়।
৪। শেখ হাসিনার আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ছাত্রলীগের দখলে। হেন কোন অপকর্ম নাই যা তারা সেখানে করে নাই। ছাত্রদল শুধু বহিষ্কৃতই ছিল না, হাতের কাছে পেলে মেরে পুলিশে দিতো। ফলে ৫ আগস্টের পরে তাদেরকে নতুন করে শুরু করতে হয়। সংগঠন গোছানোর জন্য এই নির্বাচনের আগে তারা সময় পায় মাত্র তের মাস। পক্ষান্তরে শিবির কাজ করেছে দীর্ঘ এক দশকেরও বেশী সময়কাল ধরে। সে কারনে নির্বাচনের আগেই তাদের গ্রাউন্ডওয়ার্ক করা ছিল।
৫। ছাত্রদল ভুল করেছে এই সময়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে। তাদের বোঝা উচিত ছিল হঠাৎ কেন ভিসি সাহেব নির্বাচন ঘোষনা করলেন এবং শিবিরই বা কেন এত উৎসাহী! বিএনপির ক্ষমতার স্বপ্নে মশগুল নেতারাও এ নিয়ে স্টাডি করার সময় পায় নাই। তাদের বোঝা উচিত ছিল জামাত বা শিবির কেন এখনই এই নির্বাচনের ব্যপারে উৎসাহি। তারা আপত্তি জানাতে পারতো। তাদের উচিত ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মত জাতীয় নির্বাচনের আগে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন আয়োজন না করতে সরকারকে বলা বা বোঝানো। এই স্ট্যান্ডে গোঁ ধরে থাকা। করে নাই- ধরে নিয়েছে দল যেহেতু ক্ষমতায় গিয়েই বসে আছে ডাকসু আর হাতছাড়া হয় কিভাবে! ছাত্র ছাত্রীরা সব ক্ষমতার স্বাদ পেতে দলে দলে ছাত্রদলকেই ভোট দিয়ে আসবে। ধরতেই পারে নাই নানা ধরনের বাজীতে লিপ্ত হয়ে এই দল এবং ছাত্রদলের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! সাধারন শিক্ষার্থী বিশেষ করে তরুণ যুবকদের কাছে গ্রহনযোগ্যতা কতটুকু।
৬। ১৫ বছর ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে ছিল ক্ষমতা আর অস্ত্রের জোরে। এরা সংগঠন করে নাই। এদের হয়ে সংগঠন করার কাজগুলো করে দিয়েছে অনুপ্রবিস্ট শিবির। ফলে ছাত্রলীগের নিজস্ব ভোট বলতে খুব কমই। যারাই ছিল নেতৃস্থানীয়রা পলাতক। যারা কোনমতে টিকে আছে ভোট দিতে আসার সাহস পায় নাই। যারা ভোট দিয়েছে তারা কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে। শিবিরের নেতৃস্থানীয়রা তাদের সাবেক সহকর্মী। ভবিষ্যতে ফেভার পাবার আশায় তাদের সাথে পরামর্শ করে থাকতে পারে। প্রশ্ন উঠবে তাহলে জগন্নাথ হলে ছাত্রদল এত ভোট পেলো কি ভাবে। এটাও একটা মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ হতে পারে। বিএনপিকে ভারতপন্থী হিসেবে পচানোর একটা চাল, কারন জগন্নাথ হলের ভোটাররা সবাই সনাতন ধর্মাবলম্বি।
৭। নানা অনিয়মের অভিযোগ পরাজিত প্রার্থীদের। ব্যালটে আগে থেকেই টিক মার্ক দেওয়া, প্রার্থীদেরকে কেন্দ্রে ঢুকতে না দিয়ে ইচ্ছামত টিক দেওয়া, আগে থেকেই বাক্স ভরে রাখা বা একজন ভোটারের হাতে দশ/বারটা ব্যালট পেপার পাওয়া যাওয়া। ইভিএম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কেউ কেউ। এই মেশিনটা সফ্টওয়্যার পরিচালিত। অর্থাৎ যেভাবে প্রোগ্রামিং করা থাকে সেভাবেই রেজাল্ট দেয়। তাতে ব্যালট পেপারে টিক কোথায় থাকলো কোন ম্যাটার না। বাটন টিপে দিলে সেট করা রেজাল্ট শীট বের হয়ে আসে।
এত কিছুর পরেও মোদ্দা কথা হচ্ছে শিবির পাশ করেছে। ইতিহাসে এই প্রথম জামাত রাজনীতির একটা সংগঠন ডাকসু পেলো। ৭৬ বছর আগে ১৯৪৭-৪৮ এবং ৪৮-৪৯ দুই টার্মে প্রয়াত জামাত নেতা অধ্যাপক গোলাম আজম ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন তিনি জামাত করতেন না। জামাতে যোগ দেন ১৯৫৪ সালে। এত বছর জামাত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন শিবিরকে নানা চড়াই উৎড়াই পাড়ি দিতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধীতাকারি একটা সংগঠনের ডাকসু পাওয়ার রাজনৈতিক গুরুত্ব অবশ্যই আছে। তবে জাতীয় নির্বাচনে এই ঘটনা বিরাট প্রভাব ফেলবে- এমন কোন সম্ভাবনা আমি দেখি না। দেশের অনেক বড় বড় নেতা বছরের পর বছর ডাকসু চালিয়েও রাজনীতির মাঠে খাবি খেয়ে ফিরেছেন এমন প্রমান অনেক। ডাকসুতে শিবিরের জয়লাভ দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার প্রতি ছাত্র সমাজের সমর্থন- এটাও মনে করার কোন কারন নাই। সচেতন ছাত্র সমাজ তালিবানী শাসন নিয়ে খুবই শংকিত।
আগেই বলেছি পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল একটা মেটিকুলাসলি ডিজাইনের বাস্তবায়ন। রাজনীতির সব ক্ষেত্রে এমন ডিজাইন কাজ দেবে তা নাও হতে পারে। তবে এই ঘটনা ভবিষ্যতে ক্ষমতা প্রত্যাশী বিএনপির জন্য একটা সতর্ক সংকেত সন্দেহ নাই। তারা যদি এখনও স্বপ্নের ঘোরেই থাকেন, একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখবেন রিয়্যালিটিটা এক নিদারুন দু:স্বপ্ন হয়ে গেছে।