ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি কেন সেপ্টেম্বর মাসে, চাপ নাকি কূটনীতি
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:০২ এএম, ১ আগস্ট ২০২৫ শুক্রবার

চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে ১৪৭টি দেশ। তবে স্বীকৃতির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এনেছে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডা। রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এই তিন পরাশক্তিই ঘোষণা করেছে আগামী সেপ্টেম্বরে তারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু জি-৭ ভুক্ত এসব দেশ একসঙ্গে সেপ্টেম্বর মাসকেই কেন বেছে নিলো? এছাড়া, এতদিন পর এই স্বীকৃতি দিতে চাওয়ার কারণই বা কী।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশি দূর যেতে হবে না। ২৮ জুলাই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ট্রাস্টি কাউন্সিলের চেম্বারে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সম্মেলন। এর আয়োজন করে ফ্রান্স ও সৌদি আরব। অংশ নেয় তুরস্ক। সম্মেলেনে ভাষণ দেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সম্মেলনের সহসভাপতি জঁ-নোয়েল বারো। সেখানেই তিনি সেপ্টেম্বর মাস বেছে নেওয়ার কারণ সম্পর্কে ইঙ্গিত দেন।
বক্তব্যে বারো উল্লেখ করেন, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এর সাইডলাইনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবেন প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। এই সময়টাই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা জাতিসংঘের অধিবেশনে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি অন্য দেশগুলোকেও অনুপ্রাণিত করবে।
ফ্রান্সের ঘোষণার পর যুক্তরাজ্যও বলেছে, আগামী সেপ্টেম্বরে তারা স্বীকৃতি দিতে পারে। তবে এটি কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। যেমন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির ঘোষণা না দিলে এবং কিছু শর্ত লঙ্ঘন করলে। একই পদ্ধতিতে হেঁটেছে কানাডাও। তারা শর্ত দিয়েছে, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন থেকে সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাসকে বাদ দিতে হবে।
চাপ ও পেছনের গল্প
এমানুয়েল মাখোঁর ঘোষণার পরপরই কিছু সংসদ সদস্যের (এমপি) চাপের মুখে পড়েন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। এরপর তিনি মাখোঁর সঙ্গে জরুরি আলোচনা করেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। কিন্তু কী কারণে জি-৭ ভুক্ত এই দেশগুলো তৎপর হলো?
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান বলছে, স্টারমারের সিদ্ধান্তের পেছনে আন্তর্জাতিক কারণ ও অভ্যন্তরীণ চাপ ভূমিকা রেখেছে। এর একটি স্টারমারের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীরব সমর্থন। যেটির ইঙ্গিত পাওয়া যায় সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জবাব থেকে। স্টারমারের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে গত সোমবার (২৮ জুলাই) ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘তাঁর (স্টারমার) অবস্থান নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি এখন শুধু চাই মানুষ খেতে পাক।’
অভ্যন্তরীণভাবেও চাপে ছিলেন স্টারমার। মন্ত্রীসভার কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সদস্য ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বিভিন্ন দলের ২৫০ জনের বেশি এমপি এক চিঠিতে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এসব এমপিদের মধ্যে স্টারমারের দল লেবার পার্টিরই এক-তৃতীয়াংশ।
এ ছাড়াও একটি জরিপর ফলাফলও স্টারমারকে ভাবিয়ে তুলেছিল। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত কি না এ নিয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ চালায় লেবার পার্টির অর্থদাতা ডেল ভিন্সের প্রতিষ্ঠান ‘ইকোট্রিসিটি’। এতে ৪৯ শতাংশ মানুষ ইতিবাচক সাড়া দেন। ১৩ শতাংশ বিরুদ্ধে ছিলেন।
ফ্রান্সের কূটনৈতিক ‘ইউ টার্ন’
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস ইসরায়েল হামলার পর তেল আবিব সফরে যান এমানুয়েল মাখোঁ। তখন তিনি ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের ঘোষণা দেন। এমনকি হামাসকে নির্মূল করতে একটি আন্তর্জাতিক জোট গঠনেরও আহ্বান জানান। কিন্তু তাঁর নীতিগত পরিবর্তন শুরু হয় গত এপ্রিলের শুরুতে। মিশর সফর থেকে ফেরার সময় প্রেসিডেন্সিয়াল ফ্লাইটেই তিনি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আলাপ তোলেন। সে সময় প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বীকৃতির জন্য কিছু শর্ত নির্ধারণ করে দেয়। এর মধ্যে ছিল, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কার। যদিও এর কোনোটাই পুরোপুরি পূরণ হয়নি।
ফ্রান্স ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের সহযোগী গবেষক আবদেল বাকাওয়ান বলছেন, পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশ আগেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ অবস্থায় মাখোঁর সাম্প্রতিক কিছু ব্যর্থতা কূটনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করতে ভূমিকা রেখেছে। প্যারিস এখন গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টায় আছে।
মাখোঁ একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে তৎপরতা দেখাচ্ছেন। এ জন্য গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর সঙ্গে আর্থিক সংহতি বৃদ্ধির জন্য ২০২৩ সালে একটি উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনও আয়োজন করেছিলেন। যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমনস গ্রন্থাগারের সজ্ঞায়ন অনুযায়ী, গ্লোবাল সাউথ হলো সেন্ট্রাল ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলের ১৩৪টি দেশ। যারা নিজেদের উন্নয়শীল বলে পরিচয় দেয়। মাখোঁর লক্ষ্য এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা।
স্বীকৃতিতে কিছু যায় আসে?
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডার সমর্থনের কারণে গাজার দুর্দশার চিত্র বদলাবে কি না সে আলোচনায় যাওয়ার আগে এসব দেশের বৈশ্বিক সক্ষমতার দিক জানা প্রয়োজন। তিনটি দেশই বিশ্বের উন্নত ৭টি দেশের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ফোরাম জি-৭ জোটের সদস্য। আবার সামরিক জোট ন্যাটোরও সদস্য তারা। এমন জায়গা থেকে তাদের এই স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঘোষণার বাইরে কোনো দেশই কার্যকর পদক্ষেপের বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি।
যেমন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধ বন্ধে ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ, মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি কিংবা ফিলিস্তিনি শাসন কাঠামোকে সহায়তা করবে- এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। বাস্তবে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এখনো ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার। এই স্বীকৃতির ঘোষণা সে সম্পর্কে কোনো বদলও আনেনি।
তাই, এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া আগের ১৪৭ দেশের মতো এই তিন দেশের ঘোষণাটাকেও প্রতীকী বলা যায়। লন্ডনের রয়াল হ্যালোওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রভাষক মালেক বেনসালাম দুবদুব তাঁর এক নিবন্ধে বিশ্লেষকদের শঙ্কার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, এই ধরনের স্বীকৃতি কেবল নামেই একটি রাষ্ট্রকে বৈধতা দিতে পারে। বাস্তবে এমন রাষ্ট্রের আসলে সার্বভৌমত্ব, নিজস্ব সীমান্ত, সম্পদ বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।