বন্দুকধারীর হামলায় বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তাসহ চারজন নিহত
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ১২:৪৯ এএম, ৩০ জুলাই ২০২৫ বুধবার

২৮ জুলাই, সোমবার বিকেলে নিউইয়র্ক নগরীর পার্ক অ্যাভিনিউতে ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক ও ভয়াবহ ঘটনা। নিউইয়র্ক শহরের অন্যতম ব্যস্ত ও সম্মানজনক এলাকা, মিডটাউনের ৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউতে অবস্থিত ব্ল্যাকস্টোন ও এনএফএল-এর সদরদপ্তরে এক যুবক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালায়। মুহূর্তেই শহরের অভিজাত কর্মস্থল রূপ নেয় এক মৃত্যুকূপে।
এই ঘটনার ফলে চারজন প্রাণ হারান, যাঁদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম এবং ব্ল্যাকস্টোনে কর্মরত একজন বেসরকারি কর্মচারী। গুরুতর আহত অবস্থায় আরও অন্তত দুজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হামলাকারী নিজেই পরে নিজের বুকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করে।
নিহত পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম ছিলেন ব্রঙ্কসের ৪৭ নম্বর প্রিসিংটের সদস্য। বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৬ বছর। ঘটনার সময় তিনি অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন পার্ক অ্যাভিনিউয়ের সেই ভবনের নিরাপত্তার কাজে। তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। দিদারুল নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে যোগদানের আগে কাজ করতেন ট্রাফিক বিভাগের এজেন্ট হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, নিরহংকারী এবং নিষ্ঠাবান এক মানুষ হিসেবে সুপরিচিত। তিনি দুই সন্তানের জনক এবং তাঁর স্ত্রী বর্তমানে সন্তানসম্ভবা। পরিবার, সহকর্মী ও কমিউনিটির জন্য এই মৃত্যু এক চরম শোক ও অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ পদে থাকা বাংলাদেশি কর্মকর্তা ডেপুটি ইন্সপেক্টর খন্দকার আব্দুল্লাহ জানান, ঘটনার পরপরই নগর কর্তৃপক্ষের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা হাসপাতালে উপস্থিত হন। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পুলিশ বিভাগ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয় এবং নিহত দিদারুলের মরদেহ দ্রুতই ফিউনারেল হোমে হস্তান্তর করাr প্রক্রিয়া শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে একটি গাড়ি এসে থামে ভবনের সামনে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন শেন তামুরা নামের এক ২৭ বছর বয়সী যুবক, যার পরনে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং হাতে ছিল স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। ভবনের ভিতরে ঢুকেই তিনি গুলি চালাতে শুরু করেন—প্রথমে লবির নিরাপত্তাকর্মী ও সাধারণ লোকজনের দিকে, পরে লিফট ব্যবহার করে ভবনের উপরের তলায় উঠে সেখানে আরও কয়েকজনকে লক্ষ্য করে গুলি চালান।
হামলাকারী ভবনের ৩৩ তলায় পৌঁছে আত্মহত্যা করেন। তার গাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় আরও অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ব্যক্তিগত ব্যাগ। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তার মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল। তবে হামলার উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল কি না, সে বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে।
নিউইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, "এই শহর একজন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তাকে হারিয়েছে। তাঁর আত্মত্যাগ আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।" পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই হামলায় একমাত্র হামলাকারীই জড়িত ছিল এবং ভবনটি বর্তমানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন—যেখানে প্রবেশের নিয়ম কঠোর, সেখানে কীভাবে একজন অস্ত্রধারী এত সহজে ঢুকে এত বড় ক্ষতি করতে সক্ষম হলো? এ বিষয়ে তদন্তে উঠে আসছে সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঘাটতি ও নজরদারির দুর্বলতা।
দিদারুল ইসলামের মৃত্যুতে নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নেমে এসেছে গভীর শোক ও উদ্বেগের ছায়া। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে বর্তমানে কয়েক শত বাংলাদেশি কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। সহকর্মীর মৃত্যুর পর, অনেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। একজন বাংলাদেশি হিসেবে শহরের সেবায় আত্মনিয়োগ করে জীবন উৎসর্গ করা দিদারুল হয়ে উঠেছেন সাহস ও সম্মানের প্রতীক। বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ অফিসার অ্যাসোসিয়েশন এক বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে এবং দিদারুলের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাগরিক নিরাপত্তা ও ভবন নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। যেসব বিষয় এখন জরুরি বিবেচনায় রয়েছেঃ উচ্চ-নিরাপত্তা ভবনে প্রবেশে আরও কঠোর যাচাই ব্যবস্থা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী আইন ও বাস্তবায়ন, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা সহজলভ্য ও সুলভ করা, ভবন নিরাপত্তারক্ষীদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি।