ট্রাম্পের ছয় মাসের শাসনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চিত্র
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:৫৫ এএম, ২৯ জুলাই ২০২৫ মঙ্গলবার

দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ছয় মাস পার হলো। এই সময়ের মধ্যেই মার্কিন অর্থনীতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ছাপ দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছেন—এটি ‘আমেরিকান অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সময়’। কেউ আবার বলছেন—‘অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিশ্ববাণিজ্যের উত্তেজনায় তৈরি এক অস্থির পথযাত্রা’। যাই হোক, এই সময়ের পাঁচটি প্রধান অর্থনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা করলে বোঝা যাবে—এই পরিবর্তনের খুঁটিনাটি কীভাবে প্রভাব ফেলছে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের জীবনে।
১. বাণিজ্য যুদ্ধ ২.০: শুল্ক আরোপে দাম বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি থমকে যাচ্ছে
ট্রাম্প প্রথম মেয়াদেই শুরু করেছিলেন চীনের উপর শুল্ক আরোপ। এবার তিনি সেটিকে আরও আক্রমণাত্মকভাবে কার্যকর করছেন। এখন চীনের উপর শুল্কহার প্রায় ৫০ শতাংশ। একদিকে যেমন চীনের পণ্যের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে সাধারণ আমেরিকান নাগরিকের পকেটও হালকা হচ্ছে।
জুনে মূল্যস্ফীতি ২.৭ শতাংশে পৌঁছেছে। মে মাসে যা ছিল ২.৪ শতাংশ। অনেকেই বলছেন, এই উচ্চ শুল্কের প্রভাবেই এমনটা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন—এই প্রবণতা চলতে থাকলে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’, অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধি ও মন্দা একসাথে দেখা দিতে পারে।
ট্রাম্প দাবি করছেন, এই বাণিজ্য নীতির ফলে বিদেশে চলে যাওয়া চাকরি ফেরত আসবে। বাস্তবে, উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান এখনও ১২.৮ মিলিয়নের আশেপাশেই স্থির। মজুরি বৃদ্ধিও নেমে এসেছে ৪.২ শতাংশ থেকে ৩.৯ শতাংশে।
২. কর ছাড় ২.০: ধনীদের জন্য সুখবর, গরিবদের জন্য বোঝা
সম্প্রতি ট্রাম্প ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কর ছাড় আইন পাশ করিয়েছেন। বেশিরভাগটাই ২০১৭ সালের কর ছাড়ের পুনঃপ্রকাশ। এতে ধনী শ্রেণি উপকৃত হলেও, সাধারণ মানুষের মজুরির বৃদ্ধিতে তেমন প্রভাব পড়েনি।
কংগ্রেসের গবেষণা পরিষেবার মতে, ২০১৭ সালের কর ছাড়ের পর প্রকৃত মজুরি মাত্র ১.২ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কর ছাড় ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কাটছাঁট আনতে পারে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ট্যাক্স আইন বিশেষজ্ঞ বলেছেন—এই কর নীতি আসলে “রিভার্স রবিন হুড”। গরিবদের থেকে অর্থ কেটে ধনীদের হাতে তুলে দেওয়ার এক ধূর্ত কৌশল।
৩. দুর্বল ডলার: ভালো না মন্দ?
ট্রাম্পের শাসনে মার্কিন ডলারের মান অনেকটাই কমে গেছে। ডলার সূচক ১০৯.৪ থেকে ৯৭.৩-তে নেমেছে, অর্থাৎ প্রায় ১১ শতাংশ পতন। এতে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়েছে, কিন্তু রপ্তানি বেড়েছে বলেই মনে করছেন হোয়াইট হাউসের অর্থনীতিবিদরা। ট্রাম্প অবশ্য বলেছেন—“দুর্বল ডলার মানে বেশি টাকা আসে।” কারণ, এতে বিদেশে পণ্য বিক্রি সহজ হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প ‘প্লাজা চুক্তি’ (১৯৮৫ সালের মতো এক ঐতিহাসিক চুক্তি, যা ডলার দুর্বল করে আমেরিকার রপ্তানি বাড়ায়) পুনরুজ্জীবিত করার পথে হাঁটছেন।
৪. ফেডারেল রিজার্ভে চাপ: স্বাধীনতার প্রশ্ন
ফেডারেল রিজার্ভ—যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার দায়িত্ব অর্থনীতি ও সুদের হার নিয়ন্ত্রণ। ট্রাম্প বারবার এই প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করেছেন, এমনকি চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলকে বরখাস্ত করার কথাও বলেছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—ফেডারেল রিজার্ভ কি এখন হোয়াইট হাউসের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে? যদি তাই হয়, তাহলে এটি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক নীতিমালায় এক বিরাট পরিবর্তন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি করবে। স্বতন্ত্র নীতিনির্ধারণের জায়গা হারিয়ে গেলে নীতিতে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে।
৫. শেয়ারবাজারে উত্থান, তবে গরিবদের ভাগ্যে কিছু নেই
ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির কারণে প্রথমদিকে শেয়ারবাজারে ধস নামে। কিন্তু পরবর্তীতে চীনের সঙ্গে চুক্তি ঘোষণার পরে বাজার ঘুরে দাঁড়ায়। এখন S&P ৫০০ সূচক সর্বোচ্চ উচ্চতায়। কিন্তু এতে লাভবান হচ্ছেন কারা? আমেরিকার নিম্ন আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষ মোট শেয়ারবাজারের মাত্র ১ শতাংশের মালিক।
অন্যদিকে, বন্ড বাজারে অস্থিরতা রয়ে গেছে। ব্যবসায়ী মহলেও আস্থা কমে যাচ্ছে। ভোক্তাদের মনোভাব কিছুটা উন্নতি করলেও, এখনও মহামারির আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের মাত্র ছয় মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। উচ্চ শুল্ক, দুর্বল ডলার, ব্যয়বহুল কর ছাড়, ফেডের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং অসম বাণিজ্য চুক্তির সমন্বয়ে এক অদ্ভুত অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই নীতিগুলো কারও জন্য সুফল বয়ে আনছে, আবার কারও জীবনে অনিশ্চয়তা ও জটিলতা সৃষ্টি করছে।
যে পথ ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন, তা অনেক সময় প্রচলিত অর্থনৈতিক দর্শনের বিরুদ্ধে। তাঁর এই অর্থনৈতিক অভিযাত্রা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সামষ্টিক অর্থনীতিকে কোথায় নিয়ে যাবে—তা সময়ই বলে দেবে। তবে সাধারণ মানুষ এখনই সেই প্রভাব অনুভব করছেন।