মুক্তচিন্তা
হানি ট্র্যাপ: প্রেম, ক্ষমতা ও প্রতারণার রাজনীতি
সজল আশফাক
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:২৬ এএম, ২১ জুন ২০২৫ শনিবার

ডা. সজল আশফাক একজন প্রবাসী বাংলাদেশি। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে ও দেশের বাংলা মিডিয়াগুলোতে লিখে আসছেন। সোশাল মিডিয়াতেও সরব তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তার শাণিত লেখাগুলো ফ্যাসিবাদ বিরোধী চেতনাকে উৎসাহিত করেছে। এখনও বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কার ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে লিখছেন। একাধারে কবি, চিকিৎসক, লেখক ও বিশ্লেষক। তার একাধিক বইও প্রকাশিত হয়েছে। রাজনীতিতে হানি ট্র্যাপের ব্যবহার ও তার ইতিবৃত্ত নিয়ে তিনি আজকালের এ সংখ্যায় লিখেছেন। পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
্হানি ট্র্যাপ একটি কৌশল, এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক অস্ত্র, যার ব্যবহার আজ
আর শুধুমাত্র গোয়েন্দা কল্পকাহিনীতে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্ব রাজনীতি, কূটনীতি, সংবাদমাধ্যম,
এমনকি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তব রাজনীতিতে এখন এটি একটি পরিচিত ও চিন্তাশীল শব্দ।
একে আর নিছক ষড়যন্ত্র নয়, বরং ক্ষমতার কাঠামোকে নাড়িয়ে দেওয়ার এক নীরব হাতিয়ার হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
হানি ট্র্যাপ: একটি সংজ্ঞা
্হানি ট্র্যাপ মূলত এমন একটি কৌশল, যেখানে প্রেম বা যৌন সম্পর্ককে প্রলুব্ধির হাতিয়ার হিসেবে
ব্যবহার করে কাউকে ব্ল্যাকমেইল, তথ্য আহরণ, বা সামাজিকভাবে হেয় করার প্রয়াস চালানো হয়।
এই কৌশলটির শিকার হন সাধারণত রাজনৈতিক নেতা, কূটনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা বা সমাজে
প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
বিশ্ব রাজনীতিতে হানি ট্র্যাপের ব্যবহার
রাশিয়া: কোমপ্রোম্যাট সংস্কৃতি ও তথ্য যুদ্ধ রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি (পূর্বতন কেজিবি) কম্প্রোমেট নামক একটি নীতির চর্চা কওে থাকে-এর অর্থ, কাউকে হেয় করার জন্য লজ্জাজনক তথ্য ব্যবহার করে ব্ল্্যাকমেইল করা। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প-রাশিয়া যোগসূত্র এবং ‘স্টিল ডসায়ার’ বিষয়টি এই কৌশলের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
পূর্ব জার্মানি: স্তাসির ‘সোয়ালো ও রাভেন’ কৌশল
মারকুস উলফ-এর অধীনে স্ট্যাসি নারী ও পুরুষ গুপ্তচরের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদ পেতে তথ্য আদায়
করত। এটি ছিল একটি ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত’ সম্পর্ক-ভিত্তিক গুপ্তচরবৃত্তি।
চীন: আধুনিক হোটেল ফাঁদ ও কূটনৈতিক টার্গেটিং
চীনের ‘এমএসএস’ বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলে, তা রেকর্ড করে ব্ল্্যাকমেইলের হাতিয়ার বানানোর অভিযোগে বহুবার আলোচনায় এসেছে। পাঁচতারকা হোটেলকে কেন্দ্র করে তথ্য সংগ্রহের অপারেশন বিশেষভাবে আলোচিত।
ভারত: সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রলোভনের ফাঁদ
ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো দাবি করে, পাকিস্তানের ওঝও দীর্ঘদিন ধরে আইএসআই দীর্ঘদিন ধরে হোয়াটস অ্যাপ ও ইনস্ট্রাগ্রাম এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের টার্গেট করছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখন সাইবার আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ করছে।
পাকিস্তান: বিচারপতি ভিডিও কেলেঙ্কারি
২০১৯ সালে বিচারপতি আরশাদ মালিক স্বীকার করেন, তার ব্যক্তিগত ভিডিও ব্যবহার করে একটি
পক্ষ নির্দিষ্ট রায় দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল। পাকিস্তানে হানি ট্র্যাপ আজ রাজনৈতিক
ব্ল্যাকমেইলের অন্যতম কৌশল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে: অডিও লিক ও চরিত্র হননের হাতিয়ার
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে একাধিক বিরোধী নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত অডিও
ফাঁস করে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করার চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। ২০২৩ সালে একাধিক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়া অডিও ও ভিডিও ক্লিপগুলো
যাচাই ছাড়াই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যা রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইলের একটি আশঙ্কাজনক
সংস্কৃতি গড়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে “নৈতিকতার মুখোশে লজ্জা ও সামাজিক নিগ্রহ” একটি কার্যকর কৌশলে পরিণত হয়েছে-বিশেষত এমন সমাজে, যেখানে নারীর সম্মান ও পারিবারিক মূল্যবোধ গভীরভাবে গেঁথে আছে।
হানি ট্র্যাপের পর্দার প্রতিফলন: হলিউড
চলচ্চিত্র যেমন এটমিক ব্লন্ড (২০১৭) বা জেমস বন্ড সিরিজে হানি ট্র্যাপ শুধু উত্তেজনার অনুষঙ্গ
নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবিক দুর্বলতার বিপজ্জনক মিশেল হিসেবে উঠে এসেছে। ক্যাসিনো রয়েল -এ ভেস্পার লিন্ড ও জেমস বন্ডের সম্পর্ক এই কৌশলের একটি আবেগঘন ও রাজনৈতিক
উদাহরণ।
মনস্তত্ত্ব ও নৈতিক জবাবদিহি
হানি ট্র্যাপের ক্ষেত্রে নারী চরিত্রকে প্রায়শই ‘বিপজ্জনক প্রলোভনকারী’ হিসেবে চিত্রিত করা
হয়, যা নারীর সম্মানহানিকর এবং লিঙ্গবৈষম্যমূলক। অনেক সময় সম্মতির মুখোশে ঘটে প্রতারণা,
যেখানে ভিডিও বা চ্যাট স্ক্রিনশট সামাজিকভাবে কাউকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণে বলা হয়, মানুষ সর্বদা তাৎক্ষণিক সুখ বা আকাক্সক্ষার দিকে ঝুঁকে
থাকে। তাই যারা নিজের অবস্থান ও দায়িত্ব ভুলে আকর্ষণের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, তাদের দায়
এড়ানো যায় না।
ষড়যন্ত্র না আত্মবিচ্যুতি: একটি দ্বিমুখী বিশ্লেষণ
হানি ট্র্যাপ সংক্রান্ত প্রতিটি ঘটনায় একটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়-শুধু কি এটি ষড়যন্ত্র,
নাকি ব্যক্তিগত নৈতিক বিচ্যুতির ফল? প্রতিটি ঘটনাই রাজনৈতিক বাস্তবতার দিক থেকে বিচার্য হলেও, ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে সংযত রাখতে না পারাও একটি বড় ব্যর্থতা। সমাজ, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের ওপর এর পরোক্ষ প্রভাব ভয়ংকর হতে পারে।
হানি ট্র্যাপ আজ আর গল্প নয়-এটি তথ্যযুদ্ধের বাস্তব কৌশল। ডিজিটাল যুগে এর ব্যাপ্তি আরও
গভীর ও ভয়াবহ। দক্ষিণ এশিয়ার সমাজব্যবস্থায়, যেখানে সম্মান ও ‘লজ্জা’র ধারণা ব্যক্তির
পরিচয় নির্ধারণ করে, সেখানে হানি ট্র্যাপ হয়ে উঠছে সবচেয়ে বিপজ্জনক রাজনৈতিক অস্ত্র।