বুধবার   ২২ মে ২০২৪   জ্যৈষ্ঠ ৭ ১৪৩১   ১৪ জ্বিলকদ ১৪৪৫

অসম্মান তো সবার জোটে না, আমার না হয় জুটলো

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৫৪ এএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বুধবার

তসলিমা নাসরিন: কলকাতার এক পরিচিত লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পুজোয় কোথায় লিখলেন? এরকম প্রতি পুজোর আগেই কিছু পাঠক জানতে চান কোথায় উপন্যাস লিখলাম, কোথায় গল্প, কোথায় প্রবন্ধ বা কবিতা। আনন্দবাজার, দেশ, আনন্দলোক, সানন্দা, এই সময়, বর্তমান, আজকাল কোন পত্রিকায়? আমাকে বলতে হয়, আমি কোনও পত্রিকায় লিখিনি। পাঠক মন খারাপ করে বলেন, কেন লেখেননি? আপনি কি জানেন না আমরা আপনার লেখা ভীষণ পড়তে চাই? আমাদের কেন বঞ্চিত করেন? আমি হেসে বলি, লিখিনি। কারণ কেউ লিখতে বলেননি। কলকাতার লোকটিকেও  আজ হেসে বললাম, লিখিনি কারণ কেউ লিখতে বলেননি। তারপর কথোপকথন এভাবে এগোলো।

[১] কী বলছেন, আপনাকে  লিখতে বলেনি? না তো। পুজোয় তো ওঁরা লিখতে বলেন না আমাকে। [২] আহ, আমরা তো ভাবি আপনি ইচ্ছে করেই লেখেন না। [৩] কেন এমন ভাবেন? ওসব বড়দের শারদীয়ায় আমার লেখা কখনও কী দেখেছেন? [৪] বড়দের শারদীয়ায়? [৫] ওখানে বড়রা লেখে। আমার মতো ছোটরা লেখে গ্রাম-গঞ্জের অখ্যাত লিটল ম্যাগে। [৬] কিন্তু বড় যাদের বলছেন, তারা তো তাদের কাগজে কত খবর করে আপনাকে নিয়ে। আমি এবারও হেসে বলি, হ্যাঁ খবর করেন, কে আমাকে মারলো, ধরলো, কোথায় কোন বেফাঁস কথা বলে ফেললাম, আর সে নিয়ে কী কী ঝামেলা হলো, এসব নিয়ে বিস্তর খবর। কিন্তু লিখতে বলেন   না। [৭] ও বুঝেছি, আপনার লেখা ছাপা হলে সরকার যদি গাল ফুলোয়, মৌলবাদিরা যদি গোস্বা করে। [৮] এগুলো বলে না-ছাপানোকে জাস্টিফাই করা হচ্ছে বহুকাল। খবর করলে তো সরকার বা মৌলবাদিরা গাল ফুলোয় না বা গোস্বা করে না। আসলে আমার মনে হয় আমাকে ওঁরা লেখক বা কবি বলে মনে করেন না। আমাকে একটা আইটেম গার্ল বলে ভাবেন। [৯] কিন্তু পাঠকদের মধ্যে আপনার তো প্রচুর জনপ্রিয়তা। [১০] জনপ্রিয়তাটা বড় আপেক্ষিক। পাঠক তো ওঁদের শারদীয়ায় ছাপানো লেখা পড়ছেন, বড় প্রকাশনী থেকে বেরোনো বই পড়ছেন। ওইসব বড় জায়গায় যেহেতু আমার ঠাঁই নেই, আমাকে না পড়তে পড়তে পাঠকও এক সময় আমাকে ভুলে যাবেন অথবা আমাকে আর লেখক বলে ভাববেন না।     

[১১] আপনাকে তো দুবার আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচিত কলাম আর আমার মেয়েবেলা বইদুটোর জন্য। ক’জন দুবার আনন্দ পায় বলুন। [১২] আমার ধারণা ভুল করে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। [১৩] আপনাকে এরকম ব্ল্যাকআউট করার কারণ কী? [১৪] ঠিক জানি না। তবে কিছু একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। [১৫] আপনাকে হয়তো ভয় পায়। [১৬] হতে পারে। আমি তো দেখতে অনেকটা ভাল্লুকের মতো। [১৭] সব কটা মিডিয়াই ব্ল্যাকআউট কী করে করে? [১৮] আমার বেলায় ডোমিনো ইফেক্ট বেশ চলে। একজন ব্ল্যাকআউট করলে আরেকজন করবেই। [১৯] এসব আপনার প্রাপ্য নয়। আপনার প্রতি অবিচারের সীমা নেই। [২০] আমার তো বেশ আরাম হচ্ছে। লেখার চাপ নেই। তাছাড়া ফেসবুক আর টুইটারে তো কিছু না কিছু নিয়ে মতপ্রকাশ করছি। [২১] এসব লেখা তো লেখা নয়। [২২] পাঠক যা পড়ে, তা-ই লেখা। [২৩] এসব তাৎক্ষণিক। জীবনটাই তাৎক্ষণিক। ওপার বাংলায় কি লিখছেন না? [২৪] আমার জন্য দুই বাংলা একেবারে হরিহর আত্মা। কোনও ফারাক নেই। ফারাক থাকলে একজন মানুষকে দুই বাংলাই নির্বাসন দিতো না। [২৫] আপনার জন্য কষ্ট হয়। আপনার বয়সীরা নানা জায়গায় সম্মানিত হচ্ছে, নানা পুরস্কার পাচ্ছে। [২৬] আমার কষ্ট হয় না। অসম্মান তো সবার জোটে না, আমার না হয় জুটলো। ৪৫ বছর ধরে লিখছি, এতো বছরে দুই বাংলা থেকে অসম্মান পেতে পেতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে সম্মানের নাম শুনলে চমকে উঠি। অস্বস্তি হয়। আমার এই ভালো, সম্মান টম্মান থেকে দূরে আছি, সম্মানিত ব্যক্তিদের একধরনের গাম্ভীর্য বজায় রাখতে হয়, সেটা আমার দ্বারা একেবারেই সম্ভব নয়। ফেসবুক থেকে