বুধবার   ২২ মে ২০২৪   জ্যৈষ্ঠ ৭ ১৪৩১   ১৪ জ্বিলকদ ১৪৪৫

নিষেধাজ্ঞা নয় হুশিয়ারি

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৬ এএম, ২৭ মে ২০২৩ শনিবার


 
হাসান ফেরদৌস
ব্যাপারটি মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। গত কয়েকমাস ধরেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের শুদ্ধতা নিশ্চিতকরণের দাবি জানিয়ে আসছিল। শুধু নির্বাচনী অনিয়ম নয়, নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক ক্ষেত্র যাতে সকল রাজনৈতিক দলের অনুকূল হয়, সেজন্য গণতান্ত্রিক কর্মকান্ডের সমান সুযোগ বিস্তৃত করার দাবিও তারা জানিয়ে আসছিল। সেই ধারাবাহিকতায় মার্কিন সরকার এবার জানিয়ে দিল, আগামী নির্বাচনে যদি কোন অনিয়ম হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মার্কিন ভিসা প্রদান করা হবে না।
বাংলাদেশই প্রথম দেশ নয় যার ব্যাপারে মার্কিন সরকার এই রকম কঠোর নিয়ম আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে নাইজেরিয়ায় নির্বাচনী অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাপারেও ওয়াশিংটন একই রকম সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন কার্যত অভিন্ন ভাষায় ও অভিন্ন আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে নির্বাচনী কারচুপির বিরুদ্ধে ওই দেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তের কথা জানান।
তবে এই দুই দেশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। নাইজেরিয়ার জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ তিন মাস আগে। সে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে, সহিংসতার ঘটনার ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতি বিবেচনা করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে এই অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভিসা প্রদান করা হবে না বলে জানানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে এখনো বছর খানেক বাকি। এত আগে এমন আগাম নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসায় অনেকের মনে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
মার্কিন সরকার অবশ্য বলছে এটি কোন নিষেধাজ্ঞা নয়। একটি বেসরকারি টিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্টেট ডিপার্টমেন্টের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু বলেছেন, এটি কোন ‘স্যাংসন’ নয়। একটি নতুন ভিসা নীতিমালা ঘোষিত হয়েছে যার লক্ষ্য বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে যাতে কোন অনিয়ম না ঘটে তা নিশ্চিত করা।
কারা কারা এই নতুন নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত হবেন, সেটি বেশ আগ্রহোদ্দিপক। নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেইসব ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে যারা কোন না কোনভাবে নির্বাচনী অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নতুন নিয়মের আয়তায় পড়বেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা এত বিস্তৃত যে বিস্মিত হতে হয়। সরকার, বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য সবাই ভিসা না পাওয়ার তালিকায় রয়েছেন। ইতিপূর্বে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে র‌্যাবের কতিপয় শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এবার বিচার বিভাগের সদস্যদেরও এই তালিকায় আওতাভূক্ত করা হল। এ থেকে ধারণা করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে নির্বাচনী অনিয়মের সঙ্গে শুধু সরকারি কর্তাব্যক্তিরা নয়, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সদস্যরাও সংশ্লিষ্ট থাকতে পারেন।  
এটা যদি নতুন কোন স্যাংসন বা নিষেধাজ্ঞা না হয় তাহল ঘটা করে এমন আগাম ঘোষণা দেওয়ার কি প্রয়োজন পড়ল? অনুমান করি, এই ঘোষণার মাধ্যমে মার্কিন সরকার ঢাকাকে একটি আগাম বার্তা দিতে চায় যে, নির্বাচনে যদি বড় ধরনের অনিয়ম ঘটে তাহলে ওয়াশিংটন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। কি এই ব্যবস্থা সে কথা কেউ স্পষ্ট করে বলেনি, তবে র‌্যাবের কতিপয় সদস্যদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে বাধা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে কোন সম্পত্তির মালিক হওয়া বা কোন রকমের অর্থ আদান-প্রদানে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।  
বাংলাদেশে গণতন্ত্র পিছু হটছে, এমন উদ্বেগবার্তা ওয়াশিংটন বেশ আগে থেকেই দিচ্ছে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে কথাও প্রকারান্তরে জানানো হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আহুত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না পাঠানো সেরকম একটি ব্যবস্থা ছিল। পরপর দুই বছর এই সম্মেলনে ডাক না পাওয়ায় বাংলাদেশ শুধু অবহেলিত নয়, অপমানিত বোধ করেছে, সেকথা ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু সে দাওয়াত না পাওয়ায় সরকার বিচলিত হয়নি, যা সরকার হয়েছে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন ব্যক্তিবর্গের অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তির মালিক। অনেকের পুত্র-কন্যা সেখানে উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত। তারা যদি যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সুযোগ হারান তাহলে সেটি রীতিমত অবমাননাকর, সম্পত্তি হাতছাড়া হলে তো আরো ভয়ের কারণ। র‌্যাবের ওপর যাতে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে দেন-দরবার করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন নিজেও এ ব্যাপারে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেটের সঙ্গে কথা বলেছেন, তা আমরা জানি। মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের ‘ইমেজ’ সাফসুতরো করতে একটি লবিং ফার্ম নিয়োগ করা হয়েছে, তাও অজ্ঞাত নয়।
নির্বাচনী রাজনীতি নিয়ে এই টানাপোড়েন সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী তাতে সন্দেহ নেই। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অর্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যে বার্তা পাঠান তাতে এই দুই দেশের উত্তরোত্তর সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে  ওয়াশিংটন তার ‘চীন-ঠেকাও’ নীতির অংশ হিসাবে ভারত মহাসাগর এলাকায় তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সমীকরণে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, ওয়াশিংটন সেটাই আশা করে। সেই লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে ‘সামরিক তথ্য বিনিময় চুক্তি’ স্বাক্ষরের ওপর জোর দিয়ে আসছে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঢাকা সফর করে যান মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা আফরিন আখতার। তিনি খোলামেলা ভাবেই জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সংলগ্ন সমুদ্রাঞ্চলে নজরদারি করার জন্য আধুনিক র‌্যাডার সরবরাহে আগ্রহী। এই নজরদারির লক্ষ্য যে চীন তা বলাই বাহুল্য।
এক দিকে ধমক-হুশিয়ারি, অন্যদিকে দলে ভেড়ানোর এই নীতিকে ওয়াশিংটনের উলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান ‘ক্যারট অ্যান্ড স্টিক পলিসি’ বলে অভিহত করেছেন। এই লেখককে তিনি জানিয়েছেন, একমাত্র আফগানিস্তানের তালিবান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোন দেশের নিরাপত্তা বিভাগের ওপর ওয়াশিংটন কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। সে কারণে কুগেলম্যানের কাছে বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ বা রিস্কি। এর ফলে বাংলাদেশকে চীনের দিকে ঠেলে দেওয়া হতে পারে, এমন একটি সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে চলতি বাংলাদেশ সরকার ভারতের  মোদী সরকারের যতটা ঘনিষ্ঠ, তাতে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। কুগেলম্যান মনে করেন, একদিকে গণতন্ত্র সমুন্নত করা, অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে গভীরতর সম্পর্ক নির্মাণের এই বিপরীতমুখী নীতি সুসঙ্গত মনে নাও হতে পারে। তবে চলতি টানাপোড়েন সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এই দুই দেশের সম্পর্ক বেশ শক্ত ভিতের ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মোদ্দা কথা হল, ভিসা প্রশ্নে এই নতুন নীতিমালা ঘোষণায় আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। এটি নিষেধাজ্ঞা নয়, একে ধমক, বড়জোর কানমলা বা হুশিয়ারি বলে অভিহিত করা যায়। এর একটি ইতিবাচক দিকও থাকতে পারে। ইতিপূর্বে র‌্যাবের ব্যাপারে আমরা দেখেছি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে গুম-খুনের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে। যদি এই ধমকের ফলে আগামী নির্বাচন সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রমাণিত হয় তাহলে আমাদের খুশি হওয়ারই কারণ ঘটবে।