বৃহস্পতিবার   ১২ জুন ২০২৫   জ্যৈষ্ঠ ২৮ ১৪৩২   ১৫ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

নানা আড়ম্বরে নিউইয়র্কে বাঙালিরা উদযাপন করল নববর্ষ

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৫:২৬ পিএম, ৬ মে ২০২৩ শনিবার


আজকাল রিপোর্ট
নানা  আড়ম্বরে উৎসব-আনন্দে নিউইয়র্কে উদযাপিত হয়েছে বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। ১৪৩০ বঙ্গাব্দকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্কের বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বৈশাখী মেলাসহ নানা কর্মসূচি। নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় একাধিক অনুষ্ঠানের। এসব কর্মসূচিতে বাহারি রঙের পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরে যোগ দেয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রায় প্রতিটি অনুুষ্ঠানেই ছিল আলোচনা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা।

সম্মিলিত বর্ষবরণ উদযাপন পরিষদ,নিউইয়র্ক
২৯ এপ্রিল শনিবার সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টার ‘শান্তিপুরে’ হয়ে গেল ‘বৈশাখ বরণ উৎসব ১৪৩০’।
 
 
 
 
শুদ্ধ সংস্কৃতির ধারা নির্মাণে, নতুন সম্ভবনা সৃষ্টি করা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ‘সম্মিলিত বর্ষবরণ উদযাপন পরিষদ,নিউইয়র্ক’।
ছন্দে-গীত-কবিতায় ঠাঁসা অনুষ্ঠানটি গভীর সামাজিক দায়বদ্ধতা যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছে,তেমনি নান্দনিকার দিক থেকেও অভিনব পথে হেঁটেছে। তাই তো ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নিউইর্য়কের শত শত মানুষ তাদের অনুষ্ঠানের সহযাত্রী হয়েছে।
মঙ্গলময় অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়। এসময় অতিথি হিসেবে বক্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ,বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কন্ঠশিল্পী তাজুল ইমাম,বাংলা একাডেমীর পুরস্কার বিজয়ী ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন,বিপার সংগঠক সেলিমা আশরাফ,সঙ্গীত শিল্পী মহিতোষ তালুকদার তাপস ও তার মা অঞ্জলী তালুকদার,সংগীত শিল্পী কাবেরী দাশ প্রমূখ। স্বাগত বক্তব্য করেন অনুষ্ঠানের আহ্ববায়ক ডা.প্রতাপ দাস। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সদস্য সচিব ও লেখক-সাংবাদিক শামীম আল আমিন।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠান সূচীতে ছিল প্রভাতী বর্ষবরণ,মঙ্গল শোভাযাত্রা,লোক গান,আবৃত্তি, নৃত্য, নাটক, প্রামান্য চিত্র,শিশু-কিশোরদের চিত্রাংকন ও যেমন খুশী সাজোসহ নানা আয়োজন। একঝাঁক অনুষ্ঠানসূচীর সৌন্দর্যময়তার যোগে, ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’র ভাষাও তৈরি হয়েছিল।

সকাল বেলা সুদৃশ্য মঞ্চ থেকে যখন ভেসে আসছিল ভৈরবী সুরের সৌন্দর্যধারা,ঠিক সেই সময় বৃষ্টি ভেজা সুধীজনরা সবজী,লুচি আর হালুয়ার সাথে গরম চায়ে মেতে উঠেছিল অপার আনন্দে।
‘দ্যা বিরসা চ্যাটার্জীও কোয়ার্টেট’ পরিবেশনা সবার হৃদয় স্পর্শ করেছিল। এই অনিন্দ্য সুন্দর বাজনকে দর্শক-শ্রোতারা বার বার করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করছিল। এই পর্বে সাক্সোফোনে ছিল বিরসা চ্যাটার্জী,বেস-এ ড্যানিয়েল ফিন,পিয়ানো জোয়েন ওয়েনহার্ট, ড্রামে ডমো ব্রান্চ। তাদের সুরের মূর্ছনা ছিল ভাবনাচিন্তায় প্রচন্ড ভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদ। কিন্ত উপস্থিত মুক্ত মনের বাঙালির গভীর শিকড়ে যেতে পেরেছে ।
‘শ্রুতি নাটক ও সেজানের গান‘ পর্বে ছিল ডাক্তার দম্পত্তি সেজান মাহমুদ,তৃষা মাহমুদ ও তাদেরই সন্তান রেনোয়া মাহমুদ প্রেম। এ পর্বেরও প্রতিটি সুর ও বাণী উপস্থিতিদের মর্মে-মজ্জায় মিশে গয়েছিল। তাতা থৈথৈ আনন্দে মগ্ন ছিল দর্শক-শ্রোতারা।
দুলাল ভৌমিক আর সব্যসাচী শিল্পী তাজুল ইমামের দ্বৈত লোকগীতি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হলো বাঙ্গালী জাতির হাজার বছরের গৌরবময় ঐতিহ্য-সংস্কৃতি।
সব শেষে মহীতোষ তালুকদার তাপসের নেতৃত্বে একগুচ্ছ কোরাস গান শুধু সংস্কৃতি নয়,ছিল সভ্যতার মূল্যবোধের পক্ষে মাথা উচু করে দাঁড়ানো লাল দ্রোহের কৃষ্ণচুড়া। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন-সংগ্রামের র‌্যাডিক্যাল রঙিন পোষ্টার।
দিনভর বিভিন্ন গানের অংশ অংশ নিয়েছিল সুপ্রিয়া চৌধুরী,বিদিশা দেওয়ানজী,অনুপ দাশ,অপরাজিতা কর,সাবিনা নীরু,ক্রিষ্টিনা লিপি রোজারিও,ডি চৌধুরী অসিত, দেবযানী দাশগুপ্ত, সুচরিত দত্ত, শাহরিয়ার নবী,ছন্দা নন্দি,ফুলু রায় চৌধুরী,ফারজানা সুলতানা,লায়লা ফারজানা,ফাহমিদা ইয়াসমিন,শাহরিয়ার তৈমুর,সায়গাম চৌধুরী,রুদ্রনীল দাশ প্রমূখ। যন্ত্র সংগীতে পিনাকপানি গোস্বামী,মাসুদ রানা,নাইস চৌধুরী,সৌগত সরকার,পিনুসেন দাশ,নঈম ও তুষার রঞ্জন দত্ত।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় দলীয় ভাবে অংশ নেন বাপা,বিপাসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের পরিবেশনাও ছিল দীর্ঘদিন স্মরণে রাখার মত।
পুরো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন নিউইয়র্কের তিন সংস্কৃতিজন সাবিনা নীরু,হীরা চৌধুরী ও জি এইচ আরজু।
সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ডা. প্রতাপ দাশ ও শামীম আল আমিন।
দিনের শেষে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছে, মানুষ এখনও বাংলা সংস্কৃতির স্বপ্নঘোরের উৎসভূমে জেগে আছে। তাকে রুখে দেবে সাধ্য কার !

ড্রামা সার্কল
জমজমাট আয়োজনে ৩০ এপ্রিল রবিবার ড্রামা সার্কল-এর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে গেল।
 
 

 
সন্ধ্যা ৭ টায় ড্রামা সার্কল-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সভানেত্রী নার্গিস আহমেদের বক্তব্যের মধ্যদিয়ে উড সাইডের কুইন্স প্যালেসে মুল মঞ্চে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। প্রথমেই নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন রায়হান জামান, রাহাত মুক্তাদির, মোর্তুজা কামাল সিদ্দিকী, শাহাবুদ্দিন সাগর, এটর্নী মইন চৌধুরী এবং বাংলাদেশ সোসাইটি নিউইয়র্ক এর সভাপতি আব্দুর রব,সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকী ও স্টেট সিনেটর জন ল্যু, বর্ষবরণ আয়োজন উপ কমিটির আহবায়ক রুকসান আরা ও সদস্য সচিব নিশাত খাজা।
পান্তা ইলিশ পর্বটির সুচনা করেন সিনিয়র সাংবাদিক ও পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান। সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতেই উদ্ধোধনী বৈশাখী আয়োজনে সংগীত পরিবেশন করে ড্রামা সার্কলের  শিল্পীরা। বিশেষ পরিবেশনা “বাংলার ঢোল” সমবেত ঢোল বাদনে অংশগ্রহন করে বাংলাদেশের তিন গুনী ঢুলি শফিক ও নজরুল। নৃত্য পরিবেশন করে বিপা, নীলা ড্যান্স একাডেমী, অনুপ কুমার ড্যান্স একাডেমী ও অন্তরা সাহা ড্যান্স গ্রুপের শিল্পীরা। একক সংগীত পরিবেশন করেন চন্দন চৌধুরী, লেমন চৌধুরী, ফারহানা তুলি, জাফরিন আবেদীন এবং আনোয়ারা আনা ও তার তিন পুত্র। আবৃত্তিতে অংশ নেন ফারুক আজম ও নাহরিন ইসলাম। কীবোর্ডে ছিলেন মাসুদ রানা এবং তবলা ও ঢোলে শফিক।
ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেও দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে মিলনায়তন পরিপূর্ণ হয়েছিল।
 উল্লেখ্য যে, মাঝখানে প্যানডামিক এর সময় দু’তিন বছর ছাড়া গত ২৯ বছর ধরেই ড্রামা সার্কল আয়োজন করে আসছে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
গত ৩০ এপ্রিল  উদীচী যুক্তরাষ্ট্র শাখার নববর্ষ ১৪৩০ উদ্যাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ।
 
 
জ্যমাইকার একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন উদীচী যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস । স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক আলীম উদ্দীন, সহসভাপতি শরাফ সরকার, সাংস্কৃতিক সম্পাদক ক্লারা রোজারিও।
এরপর উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী দলীয়গান এবং ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়।এতে অংশ গ্রহন করেন রফিকুল ইসলাম, আশীষ রায়, প্রবীর দাশ, সুলেখা পাল, ক্লারা রোজারিও, লিলি মজুমদার, ফুলু রায়চৌধুরী, স্নিগ্ধা আচার্য, সুপর্ণা সরকার, মুনমুন সাহা, রাবেয়া আক্তার। নাচে-সিথিয়া রিয়া, অনিন্দিতা ভট্টচার্য, দেবস্মিতা চৌধুরী, রাউওশী বিশ্বাস, শিশু শিল্পী পূর্ণাত্তম সাহা, সুদীপ্তা ধর, আদৃতা ধর, শিবাদিত্য দত্ত, দেবাদিত্য দত্ত, পারমিতা রায়ও ন্যিশাত হাস।
নাচ-গান-কবিতা আবৃত্তিতে আনন্দে ভরপুর ছিল অনুষ্ঠানটি। বৃষ্টির কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি বাহিরে করা সম্ভব হয়নি । তবে হলের পাশে সীমিত আকারে করে নিয়ম রক্ষা করা হয়েছ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুর আগে পিঠা উৎসব  উপভোগ্য ছিল । অনুষ্ঠান শেষে ঘরে তৈরি পহেলা বৈশাখের আলু, বেগুন,সুটকি, কচু ভর্তা সহ নানা স্বাদের বাঙালি খাবার পরিবেশন করা হয়। বৈরি আবহাওার মধ্যেও দর্শক-শ্রোতাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত।