হারিয়ে যাওয়া পানাম নগরী
নিজস্ব প্রতিবেদক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৩১ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ বুধবার
ভ্রমণের চেয়ে ভালো বিনোদনের বিকল্প হয় না। এজন্যই আজকাল ডে-ট্রিপের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। মানে দিনে বেড়াতে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা। ডে-ট্রিপের জন্য একটি আদর্শ স্থান ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত পানাম নগরী। সেখানে অনায়াসেই পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে পারে যে কেউ। একাও ঘুরে আসা যায় চাইলে।
এর আগে বেশ কয়েকবার পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে পানাম নগরীতে ঘুরে এসেছি। তবুও এর আকর্ষণ আমার কাছে কখনও পুরনো হওয়ার নয়। তাই গত নভেম্বরে আবারও ঐতিহাসিক এই স্থানে বেড়িয়ে এসেছি কিছুটা সময়। এবার একাই গিয়েছিলাম। একা ভ্রমণের আনন্দ অন্যরকম। এক্ষেত্রে সবকিছু নতুন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ ঘটে।
ঢাকা থেকে গুলিস্তান হয়ে নারায়ণগঞ্জে যাওয়া যায় সহজে। এরপর অটোতে চড়ে সোনারগাঁও। এবার অবশ্য বন্ধুর গাড়ির সুবাদে একটু বিলাসী ভ্রমণ করেছি। সারাদিনের জন্য গাড়ি ও ড্রাইভার বরাদ্দ ছিল। তাই নির্ঝঞ্ঝাট যাওয়া-আসা হয়েছে।
ঢাকা থেকে রওনা হই দুপুর ১২টার দিকে। অফিসে আগে থেকেই বলে রাখায় ছুটির কয়েক ঘণ্টা আগেই বেরোতে পেরেছি। গাড়ি তৈরিই ছিল। মোটামুটি ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে পৌঁছেছি পানাম নগরী। কিন্তু ভেতরে একটু পরে যাবো সিদ্ধান্ত নিলাম। এর পেছনে দুটি কারণ ছিল।
প্রথমত, আকাশে মেঘের ঘনঘটা আমার ছবি তোলার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয়ত, প্রবেশপথের সামনেই ছিল মিষ্টান্নের দোকান। স্থানীয় খাবার আমার প্রতিটি ভ্রমণের বিশেষ অংশ। তাছাড়া দুপুরের খাবারের সময়ও হয়ে গিয়েছিল। তাই দেরি না করে পেটপূজোটাই সেরে নিলাম। রসগোল্লা, চমচম ও কালোজামের স্বাদ নিয়েছি। সব মিলিয়ে খরচ ছিল ৫০ টাকারও নিচে। এরপর চায়ে চুমুক দিয়ে দেখি সূর্যের আলো মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়েছে। আর দেরি করার প্রয়োজন মনে হলো না। টিকিট নিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
আমার আগেরবারের দেখা পরিবেশের সঙ্গে এখনকার পানাম নগরীর বেশ অমিল। এজন্য ভেতরে ঢুকেই চমকে যেতে হলো। এখনকার পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। অপ্রয়োজনীয় কোনও বস্তু বা আবর্জনা খুব একটা চোখে পড়েনি। ছুটির দিন না হওয়ায় ভিড় তুলনামূলক কম ছিল।
ভেঙে পড়া ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মেরামতের কাজ যদিও দেখিনি। রঙ দিয়ে মেরামত করলে এগুলোর স্থায়িত্বকাল আরও বাড়ানো সম্ভব। ইট আর টেরাকোটার স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার ইতিহাসের এই অন্যতম নগরী। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মন্যুমেন্ট ফান্ড বিশ্বের ১০০টি ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে পানাম নগরীকে।
প্রায় ৪৫০ বছর পূর্বে বাংলার বিখ্যাত বার ভূঁইয়াদের নেতা ঈশা খাঁ পঞ্চদশ শতাব্দীতে সোনারগাঁওয়ে ২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাংলার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এটাই ‘দ্য লস্ট সিটি’ নামে পরিচিত পানাম নগরী। সেই আমলে মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীর মাধ্যমে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন রফতানি হতো। বিদেশি কাপড়ের আমদানি থাকায় পানাম পরিচিতি লাভ করে বন্দর নগরী হিসেবে। মূলত মসলিন ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের জন্যই এই নগরী গড়ে তোলা হয়।
বর্তমানে পানাম নগরীতে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ৫২টি ভবন অবশিষ্ট রয়েছে। মোগল ও গ্রিক স্থাপত্যের অনুসরণে তৈরি এগুলো। এসবে স্থানীয় শিল্পীদের হাতের নিপুণ ছোঁয়া পাওয়া যায়। ভবনগুলো ছাড়া এখানে আরও বেশকিছু ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে।
পানাম নগরীর কাছেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তৈরি লোকশিল্প জাদুঘর অবস্থিত। তাই একদিনের ছুটিতে ইতিহাস ও শিল্পের মাঝে ডুব দিতে এটি একটি আদর্শ স্থান। কয়েক বছর ধরে এই ঐতিহাসিক স্থান সরকারি তত্ত্বাবধানের আওতায় আনা হয়েছে। তাই এখানে নিয়ম-কানুন মেনে চলা আবশ্যক।
ঘোরাঘুরি শেষে বেশকিছু ছবি তুলে যখন ফিরতি পথ ধরেছি তখনও বিকাল হয়নি। তাই আশেপাশের আরও কয়েকটি জায়গায় বেড়িয়ে তারপরে বাড়ির পথ ধরি। বাস আর অটোতে চড়ে পানাম নগরীতে গেলেও খরচ সীমিত। মোটামুটি ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যেই যাতায়াত সম্ভব। খাওয়া-দাওয়ার পছন্দের ওপর বাকিটা নির্ভর করছে।
