রোববার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫   পৌষ ১৩ ১৪৩২   ০৮ রজব ১৪৪৭

১ মার্চ ১৯৭১, কী হয়েছিল সেদিন?

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০২:৪৩ পিএম, ১ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার

একাত্তরের ১মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেয়। এই ঘোষণাটি যখন রেডিওতে প্রচার করা হল, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সঙ্গে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা চলছিল। মুহূর্তেই জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে এক যুদ্ধক্ষেত্র। বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট সবকিছু। রাস্তায় নেমে আসে লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী মানুষ। দেখতে দেখতে পুরো শহর পরিণত হয় একটি মিছিলের নগরীতে। মিছিলে অংশ নেওয়া মানুষের মুখে তখন স্বাধীনতার স্লোগান : ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাদেশে ৫দিনের হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্য অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এরপর কারফিউ জারি হলো-ছাত্র-জনতা সেই কারফিউ ভেঙ্গে পথে নেমে এল। চারিদিকে মিছিলের শব্দ, স্লোগান আর স্লোগান। সেনাবাহিনীল গুলিতে মানুষ মারা গেল। কিন্তু মুক্তিকামী মানুষের জোয়ার থামলো না।

১ মার্চের এই বিক্ষোভ রচনার দীর্ঘপথ

পাকিস্তানে- দেশের বাজেটের ৬০শতাংশ ব্যয় করা হতো পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পিছনে। তারা বেসামরিক মানুষের হাতে সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না। নানা রকম অস্থিরতার ভেতর দিয়ে ১৯৫৮সালে পাকিস্তানের সেনাপতি আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে। আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল টানা ১১বছর। তার শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের ওপর নানা বঞ্চনা চলতে থাকে।

আওয়ামী লীগের তেজস্বী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করেন। অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই দাবি করার জন্য গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে দেশদ্রোহিতার মামলায় প্রধান আসামি করা হয়।

 

পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হল। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিল ছাত্ররা। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন জেলের বাইরে, তিনিও এগিয়ে এলেন। আন্দোলন গণ-বিস্ফোরণে রূপ নিল। গণ-আন্দোলনে প্রাণ দিল কিশোর মতিউর। প্রাণ দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ, যার নামে আইয়ুর গেটের নাম হয়েছিল আসাদ গেট। পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

ইতিহাসের আর এক পরিবর্তন শুরু হলো- পাকিন্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে বিদায় নিল। ১৯৬৯-এর ২৫মার্চ  ক্ষমতায় এলো জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ক্ষমতায় এসেই সাধারণ নির্বাচন দেবার ঘোষণা করে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে- পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ আসনের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ১৬০ আসনে জয় লাভ করে। যখন সকল আসনে নির্বাচন শেষ হলো দেখা গেল- মনোনীত মহিলা আসনসহ পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ ১৬৭টি, পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পিপলস পার্টি পলে ৮৮টি আসন। অন্যান্য সব দল মিলে পেল বাকি ৫৮টি আসন।

বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ৬দফার দাবি করে জনগণের ভোট পেয়েছেন, তিনি শাসনতন্ত্র রচনা করবেন ছয় দফার ভিত্তিতে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তখনই সিদ্ধান্ত নিল, কোনোভাবেই বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেবে না। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান নিজেদের অজান্তে ‘বাংলাদেশ’ নামে নতুন রাষ্ট্র জন্ম দেবার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল।

 

জুলফিকার আলী ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লারকানায় ‘পাখি শিকার’ করতে আমন্ত্রণ জানাল। ‘পাখি শিকার’-এ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগ দিল পাকিস্তানের বাঘা বাঘা জেনারেল। ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্রের নীল নকশা সম্ভবত সেখানেই হয়েছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৩ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করলো ৩মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। ১৯৭১সালের ২১ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন করা হল অন্য এক ধরণের উন্মাদনায়।

এরপর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ঠিক দু’দিন আগে ১মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিল। এরপরই সারাদেশে বিক্ষোভ শুরু হল। শুরু হলো স্বাধীনতার পথে বিরামহীন যাত্রা।