শনিবার   ২২ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩২   ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

খালেদ খান : খসে পড়া নক্ষত্র

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৯:২৩ পিএম, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

খালেদ খান খ্যাত ছিল ‘যুবরাজ’ ডাকনামে, সত্যিকার অর্থেও সে ছিল অভিনয় জগতের যুবরাজ। কীর্তিমান এই অভিনেতা আমাদের দেশের মঞ্চকে শোভিত করেছে অনন্য দ্যোতনায়।

তার অকাল প্রয়াণের আগে আমার সঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করেছে আমারই নির্দেশিত রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে। এক সময় বলত, আতাউর ভাই, আমি আর পারছি না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ‘রক্তকরবী’ নাটকের কয়েকটি প্রদর্শনী বিশু চরিত্রে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিল। পরে জানাল তার কণ্ঠস্বর আর কাজ করছে না।

মোটর নিউরন ব্যাধিতে ও অকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমার নির্দেশিত ৮৪টি প্রদর্শনীতে ‘রক্তকরবী’ নাটকে ‘বিশু’ পাগলের ভূমিকায় সেরা অভিনয়টি করেছে খালেদ খান। তার বাচিক অভিনয় ছিল অনন্য।

নন্দিনীকে যখন গান শোনাত বিশুর চরিত্রে অভিনয়রত খালেদ খান- ‘তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ/ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া’ সে ছিল এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। এমন করে এ গানটি অন্য কোনো বিশুকে গাইতে আমি দেখিনি। আমি ‘রক্তকরবী’ নাটকে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করতাম।

নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করত অপি করিম। আমার ধারণায় ‘রক্তকরবী’ নাটকের প্রাণ পুরুষ ‘বিশু’ এবং খালেদ খান এ চরিত্রে ছিল অতুলনীয়। খালেদ খান নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি প্রযোজনায় আমার সহঅভিনেতা ছিল। আমার নির্দেশনায় অভিনয় করেছে। আবার আমিও খালেদের নির্দেশনায় অভিনয় করেছি।

খালেদ খান আমার নির্দেশিত ‘ঈর্ষা’ নাটকে এক অকল্পনীয় পারঙ্গমতায় অভিনয় করেছিল। সৈয়দ শামসুল হক রচিত এই নাটক দীর্ঘ ছয়টি কাব্য সংলাপে সমাপ্ত।

এক একটি সংলাপের স্থায়ীত্বকাল ছিল ১৮ মিনিট থেকে ২০ মিনিট। খালেদ খান অভিনয় করত ‘যুবক’ চরিত্রে, সারা যাকের অভিনয় করতেন ‘যুবতীর’ ভূমিকায় এবং জামাল উদ্দিন হোসেন অভিনয় করতেন প্রৌঢ় চরিত্রে।

এ নাটকটি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের জন্য ছিল এক বিরাট পরীক্ষা এবং সে পরীক্ষায় আমরা উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এ নাটকটি যখন ‘কলকাতা একাডেমি অব সাইন্স অ্যান্ড আর্টস’ মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়, তখন দর্শকের মাঝে ঝড় তুলেছিল।

এ ঘরানার নাটক ছিল তাদের দেখা প্রথম নাটক। খালেদ খানের অভিনয় কলকাতায় দর্শকদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। বাংলা থিয়েটার কিংবদন্তি অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশক শম্ভুমিত্র এ প্রযোজনা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকও আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন।

খালেদ খানের অভিনয় দেখে কলকাতার দর্শকরা বলেছিলেন- যৌবনে শম্ভুমিত্র খালেদ খানের মতো অভিনয় করতেন। এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে।

নির্দেশক হিসেবে আমি দেখেছি, সামান্য ব্যাখ্যা দিলেই খালেদ খান সব বুঝে নিত। নির্দেশকের অভিপ্সাকে রূপায়িত করতে ওর বিন্দুমাত্র সময় লাগত না। প্রত্যেক অভিনেতাই পুরুষ অথবা নারী চরিত্রে নিজস্ব বাচনভঙির জন্যই একে অন্যের চেয়ে আলাদা হয়। শেকসপিয়রের হ্যামলেট নাটকের বিশ্বনন্দিত ৫-৬ জন অভিনেতা অভিনয় করেছেন।

প্রত্যেকেই ভালো কিন্তু আলাদা; কেবল দৈহিক ও বাচিক অভিনয়ের ভিন্নতার জন্য। খালেদ খান তার নিজস্ব বাচনভঙির জন্য সবার চেয়ে আলাদা হয়ে উঠেছিলেন এবং সে জন্যই মঞ্চে তাকে আলাদা করে চেনা যেত।

তার অভিনীত টেলিভিশন নাটকগুলোয় তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যেত।

সংখ্যার দিক থেকে খুব কম হলেও চলচ্চিত্র অভিনয়ে খালেদ খান প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিল। তার মধ্যে সদা প্রশিক্ষণরত এক সত্তা বাস করত; যে কারণে প্রথাগত সঙ্গীত সাধনা না করেও খালেদ খান রবীন্দ্রনাথের গান গাইত এক অনন্য পারঙ্গমতায় এবং মনোগ্রাহী আবৃত্তিও করত।

খালেদ খান ছিল আমার পুত্রবৎ। সে জন্য আমার সম্বোধন তার ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়েছে। বিখ্যাত লেখক রশীদ হায়দার টাঙ্গাইল থেকে আগত এ যুবককে আমার বাসায় নিয়ে এসেছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য করার জন্য।

তখন আমি বলেছিলাম- তোমাকে দিয়ে অন্য কিছু হলে হতেও পারে কিন্তু অভিনয় হবে না। সেই খালেদ খান যুবরাজই আমাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে সারা জীবনের জন্য আমার বিস্ময় হয়ে রইল। রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন নাটকে আমার সহঅভিনেতা হিসেবে সে এ নিচের গানটি গাইত-

তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে

কেউ তা জানে না

আমার মন যে কাঁদে আপন মনে কেউ তা মানে না

ফিরি আমি উদাস প্রাণে তাকাই সবার মুখের পানে,

তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না’।

খালেদ খান যুবরাজ সম্পর্কে প্রয়াণ দিবসে উল্লিখিত পঙ্ক্তিমালাই আমার ভালোবাসার উচ্চারণ। খালেদ খান যুবরাজ মুখে আগুন নিয়ে এসেছিলেন এবং সেই আগুন নিয়ে চলে গেল অসীমের ঠিকানায়।