রোববার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫   পৌষ ১৩ ১৪৩২   ০৮ রজব ১৪৪৭

স্যালুট ফায়ার ফাইটার

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ১০:২০ এএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ রোববার

প্রতি বছরের মতোই নানা ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করা হবে একুশের রাত। স্বর্গীয় ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা বুকে নিয়ে কোটি কোটি বাঙালি প্রস্তুত শহীদদের সম্মান জানাতে। ফাগুনের শিশির ভেজা ওই শীতল রাতে ছোট ছোট শিশুরা নানা রঙের ফুল হাতে শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে প্রতীক্ষা করছে। তখনই ঢাকার চকবাজারের চুরিহাট্টায় দেখা দিল ভয়ঙ্কর এক অগ্নিকাণ্ড।  

 

এর শুরু একটি প্রাইভেটকারের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। চোখের পলকে নিষ্ঠুর-সুন্দর লাল-কমলা নারকীয় আগুন গ্রাস করে নিল ওয়াহেদ ম্যানশন। পরের কয়েক মূহুর্তে আশপাশের আরো ৪টি ভবন। এর প্রতিটি ভবনই ৫ থেকে ৬ তলা।

এই পৈশাচিত শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য সাহস বুকে নিয়ে মানবতার সেবায় সবার আগে এগিয়ে এলো ফায়ার ফাইটাররা। সোজা বাংলায় যাদের বলা হয় দমকল কর্মী। ঐতিহাসিক শোকের রাতে আবারো শোকে কাতর হলো পুরো দেশ। চুরিহাট্টার আগুনে এরই মধ্যে কেড়ে নিয়েছে ৬৭ জনের প্রাণ।

আমরা সবাই খবর পড়েছি বা দেখেছি, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের ৩৭টি ইউনিট এই ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করছেন। খুব বেশি হলে এতে কর্মী সংখ্যা উঠে আসে। তবে, কেউ কি লিখেছে বা বলেছে,  এ নারকীয় আগুনের সঙ্গে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছেন আমাদের সূর্যসন্তান এই ফায়ার ফাইটাররা। যাদের কোন ভয় যেন নেই, বিকারহীনভাবে আগুন মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে আগুনেরই মাঝে। এর মধ্যে রয়েছে যন্ত্রপাতির স্বল্পতাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা। 

 

ওই এলাকায় কোন কোন জায়গায় গাড়ি ঢুকতেই পারে না-এতো সরু রাস্তা। বাংলার এই দামাল ছেলেদের মহান সেবার নিদর্শন রিপোর্টিং এর সুবাদে নিজে প্রত্যক্ষ করেছি বেশ কয়েকবারই। তাজরিন, রানাপ্লাজা, নিমতলী ও সর্বশেষ চুরিহাট্টায়। ফায়ার ফাইটারদের স্যালুট।

ভাবনা আসতেই পারে, কতো বড় মন হলে একজন ফায়ার ফাইটার হওয়া য়ায়। একজন কর্মী থেকে বাহিনী প্রধান পর্যন্ত সবাইকে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি চকবাজার ট্রাজেডির সময়। একদিকে সুমধুর আজানের ধ্বনি বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে কামানের মত বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার বা কোন কেমিকেল ড্রাম। লেলিহান অগ্নিশিখার কাছে সূর্য় তখন যেন ম্লান মনে হচ্ছিল। 

চুরিহাট্টা জনপদে দিনের শুরুটা হয়েছে ভয়াবহ প্রাণ কেড়ে নেয়া ওই তাণ্ডবের মধ্য দিয়ে। অথচ সেই রাত পৌনে ১১টা থেকে নিরলস-নির্বিকারভাবে কাজ করেছেন ফায়ার ফাইটাররা। যত বেশি জীবন-সম্পদ রক্ষা করা যায় সে চেষ্টায় হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আগুন মোকাবিলায়। তারা কিছুতেই যেন হার মানবে না। হয়তো বা নিজে দগ্ধ বা মরেও যেতে পারে- এসব কিছুকেই তারা পরোয়া করেন না। 

 

তবে, অনেকেই বলতে পারেন- এটাই তাদের কাজ। বিশেষ করে আপনি (ফায়ার ফাইটার) যখন জানেন, কি করতে যাচ্ছেন। শুধু কেমিকেল নয়, কেমিকেল গোডাউন বা কারখানায় আগুন লাগলে তা কত ভয়াবহ তা জেনেও আপনি সেই নারকীয় তাণ্ডব থেকে মানবতাকে-মানুষকে বাচাঁতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। রয়েছে পানির স্বল্পতা, গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারছে না, নেই কেমিকেলসৃষ্ট আগুন নেভাতে বিশেষ ফোম (ফেনা জাতীয় এক ধরনের অগ্নিনির্বাপক কেমিক্যাল)।

অন্যদিকে আশ্চর্যের বিষয়, দেশে এতগুলি ভয়াবহ ঘটনার পরও দমকল বাহিনীর আগুন নেভাতে বিশেষভাবে নির্মিত হেলিকপ্টার নেই। যদিও বিমান বাহিনী চকসহ আগের দুটি (এটিএন ও বসুন্ধরা সিটি শপিং মল) আগুনের ঘটনায় সাহায্য করেছে। তবে এবারই প্রথম রাতে অপারেশন চালাতে হয় বলে জানান ওই রাতে দায়িত্বরত বিমান বাহিনীর এয়ার কমোডর জাহিদ হাসান।

এদিকে এতো ঝুঁকির পরও প্রতিটি দুর্যোগে সফল হয়েছে, আগুনকে বসে এনেছে ফায়ার সার্ভিস। অধিক মাত্রায় জানমালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে। চুরিহাট্টায় আমার সামনেই এক কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। 

আর বাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মদ এক অসাধারণ মানুষ। খুব সখ্যতা না থাকলেও দেখছি-জানছি বেশ কয়েক বছর। প্রতিটি দুর্যোগে অক্লান্ত পরিশ্রম করেও হাসিমুখে গণম্যাধ্যম কর্মীদের তথ্য দিচ্ছেন। কর্মীদের সমস্য শুনছেন, সমাধান বাতলে দিচ্ছেন। আবার উচ্চ পদস্থ বলে আগুন থেকে দূরেও নেই। যখন কাটারা মসজিদের সিড়িতে ক্লন্তিতে হেলান দিয়ে একটু বসেছেন জিরিয়ে নিতে, তখনো উনি জানেন, বিশাল একটি বোমার উপর বসে আছেন তিনি। তখনও দ্রিম দ্রিম শব্দে ফাটছে কেমিক্যাল ক্যনিস্টার বা সিলিন্ডার। তখনো নির্দেশ নিতে বা তথ্য জানাতে আসা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাহস দিচ্ছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন। তথ্য জানাচ্ছেন সংবাদকর্মীকে। 

 

এসব মানুষদের কথা আমরা কেউই বিস্তারিত লিখিনি বা জানাইনি। তাই মনে একটা তাগিদ ছিল। তারাও মানুষ, তাদেরও স্ত্রী-সন্তান ও স্বজন রয়েছে। তারপরও তারা একটু ব্যতিক্রমী বড় মাপের মানুষ। আলাদাভাবে একটু ধন্যবাদ দিলে কি ছোট হয়ে যাই আমরা!

এভাবেই ফায়ার ফাইটার নামের দেবদূতরা চুরিহাট্টার মতো ধ্বংসাত্মক আগুনসহ বড় বড় দুর্যোগে বরাবরই আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। এদের মন-দিল কি হিরে দিয়ে বাঁধানো! বড়ই কঠিন এক প্রশ্ন, এইসব মানুষ মানবতার জন্য খুবই মূল্যবান।

ওই রাতে বলা যায় একটু দেরিতেই পৌঁছেন আরেক মানবতার সেবায় কাজ করা ব্যক্তি, ফায়ারের পরিচালক (অপারেশন) মেজর সাকিল। তিনি উত্তরা থেকে আসেন। হাতে হেলমেট। দেখে মনে হলো আসার সময় গাড়িতে বসেই ড্রেস পড়েছেন। ড্রেস পড়ার সময়টুকুও নষ্ট করেননি। এসেইে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই মহাশক্তির আগুনকে বশে আনতে। দীর্ঘ ১২ ঘন্টার অবর্ণনীয় কষ্টের পর সহকর্মীদের নিয়ে আগুন নেভাতে সক্ষম হন। 

চুরিহাট্টায় আরো অনেক ঘন্টা পর নির্বাপণ কাজ সম্পূর্ণ শেষ করে আক্রান্ত এই মানুষগুলোকে নিরাপদ করা হয়। এতে স্থানীয় অনেকেই সাহায্য করেছেন। দুর্যোগে বাঙালি সব সময়ই এক হয়ে লড়াই করে। কিন্তু এসব দৈব দুর্যোগে প্রধান কাজটি করে ফায়ার ফাইটার নামের সোনার ছেলেরা। তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তাদের আন্তরিক ভালবাসা। সালাম ফায়ারম্যান!