বাকরখানি ও একটি প্রেমকাহিনী
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১০:৫০ এএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শনিবার

আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি,
বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি…….
আজকাল বিদেশি খাবারে দোকানপাট ভড়ে গিয়েছে। আর একটা সময় বাঙালি খাবার বলতে হাতে গণা কিছু নাম সবার মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত। তাছাড়া বাংলা খাবার বলতে সবার আগে পুরান ঢাকার খাবারের নাম চলে আসে। আর পুরান ঢাকার মোগলাই খাবারের আগেও যে নামটি আসে সেটা হচ্ছে বাকরখানি। পুরনো ঢাকার তিন শতাব্দীর ঐতিহ্যের ধারক বাকরখানি এখনো চাহিদার শীর্ষে অবস্থান করছে। ফাস্টফুড বলেন আর সকালের নাস্তা বাকরখানি ছাড়া পুরান ঢাকার মানুষ এখনো অন্য কিছু ভাবতেই পারেন না।
ফাষ্টফুড বলেন আর পাঁচতারা হোটেলের বেষ্টফুড বলেন, মচমচে মুখরোচক বাকরখানি, এটা এখনো তুলনাবিহীন। সমাজে বদলে গেছে মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও রুচিবোধ। কিন্তু বদলায়নি বাকরখানির চমৎকার স্বাদ। এর চাহিদা অতীতে যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। বরঞ্চ দিন দিন চাহিদা আরো বাড়ছে। আগে আর গণ্ডি ছিল শুধু পুরান ঢাকার মাঝেই। এখন দেশ জুড়ে আপনি দেখতে পাবেন বাকরখানির দোকান।
পুরানো কালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাকরখানি তৈরির পিছনে রয়েছে অমর প্রেমকাহিনী। আগা বাকের নামে তুর্কিস্তানের এক ভাগ্যবিড়ম্বিত বালক ক্রীতদাস হয়ে এসেছিল এ দেশে। বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ ক্রীতদাসরূপী সুদর্শন এ বালকটিকে কিনে নিয়েছিলেন। আগা বাকেরের বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব তাকে লেখাপড়া ও সামরিক বিদ্যায় সুশিক্ষিত করে তোলেন। যৌবনে আগা বাকের প্রথমে চট্টগ্রামে ফৌজদারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি বাকলা চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন। তার নামানুসারে বাকেরগঞ্জ। (পরবর্তীকালের বরিশাল) জেলার উৎপত্তি হয়।
অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের নায়ক আগা বাকেরের প্রেমকাহিনী ইতিহাসের পাতায় বহুল আলোচিত বিষয়। আগা বাকের ভালোবেসেছিলেন সুন্দরী নর্তকী খনি বেগমকে। তার প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উজির জাহান্দার খাঁর ছেলে কোতোয়াল জয়নুল খাঁ। এই নর্তকীকে ঘিরে আগা বাকের ও জয়নুল খাঁর প্রেমকাহিনী ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত এ কালের মারদাঙ্গা ছায়াছবিকে হার মানায়।
সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সূত্র ধরে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করেছিলেন। শক্তিধর কুশলী যোদ্ধা বাঘকে হত্যা করে খাঁচা থেকে বীরদর্পে আগা বাকের বেরিয়ে এসেছিলেন। খনি বেগমকে হরণ করে দুর্গম চন্দ্রদ্বীপের গহীনে পালিয়ে গিয়েছিলেন জয়নুল খাঁ। আগা বাকের প্রেমিকাকে উদ্ধারে রণসাজে চন্দ্রদ্বীপে উপস্থিত হলে জয়নুল খাঁ খনি বেগমকে হত্যা করে নিজে আত্মঘাতী হন।
নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তীর ঢাকা’ গ্রন্থে এ ঐতিহাসিক কাহিনীর বর্ণনায় বলা হয়েছে, খনি বেগমকে না পেলেও প্রেমের স্মৃতি চিরজাগরুক রাখতে আগা বাকের নতুন ধরনের শুকনো রুটি তৈরি করিয়ে নাম দিয়েছিলেন বাকের খনি। সাধারণ মানুষের উচ্চারণে যা ক্রমে ‘বাকরখানি’ হয়ে গেছে।
অতীতে ময়দার সাথে দুধের মালাই ও মাখন মিলিয়ে খামির তৈরি করে বাকরখানি বানানো হতো। এটা ছিল নবাব আর আমীর ওমরাদের অন্দরমহলে প্রিয় খাবার। মালাই-মাখনের বাকরখানি এখন আর তৈরি হয় না। তবে ঢাকার অনেকে পুরনো ‘খানদানি’ পরিবার বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য আগাম অর্ডার দিলে মালাই-মাখনের বাকরখানি সরবরাহ করা হয়। আগে ঢাকার বনেদি পরিবার নিজেদের বাড়িতেই বাকরখানি তৈরির আয়োজন ও কারিগর রাখতো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে দুধের মালাইয়ের পরিবর্তে বাকরখানিতে ডালডা তেল ব্যবহারের প্রচলন হয়।
সাধারণ রুটি-পরোটার সাথে বাকরখানি তৈরি ও এর স্বাদের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। কারিগরদের ভাষায়, বাকরখানির খামির তৈরিতে পানির বদলে পরিমাণমত সয়াবিন-ডালডা ব্যবহার করা হয় এখন। চুল্লিতে ভাজার সময় তেল-ডালডা আগুনের তাপে একেবারে শুকিয়ে ময়দা মচমচে হয়ে যায়।
বাকরখানির এখনো কেমন চাহিদা, সেটা চানকারপুল পার হয়ে নাজিমুদ্দীন রোডের দু’পাশে তাকালেই বোঝা যায়। রাস্তার দু’পাশেই পরপর অনেকগুলো বাকরখানি তৈরির দোকান। এসব দোকানের বাকরখানি সাদা পলিথিনের প্যাকেটে ভরে ধানমন্ডি, উত্তরা, বনানী, গুলশানসহ রাজধানীর দোকানে ও ডিপার্টমেন্ট, স্টোরে সরবরাহ করা হয়।বিদেশে পাঠানোর জন্যও বড় ক্রেতারা কিনে নিয়ে যায়।
আমলীগোলা, ইসলামবাগ, হাজারিবাগ, লালবাগ, চকবাজার, আবুল হাসনাত রোড, আগা সাদেক রোড, নাজিরাবাজার, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, বনগ্রাম, মৈশন্ডি, লক্ষ্মীবাজার, একরামপুর, সুত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, বাসাবো এক কথায় পুরনো ঢাকার সর্বত্র অলিগলিতে বাকরখানির দোকান নজরে পড়ে।
পুরনো ঢাকার ধনী-দরিদ্র সব পরিবারে অতিথি এলে চায়ের সাথে বাকরখানি দিয়ে আপ্যায়নের রেওয়াজ এখনো প্রচলিত। রুটি বা পরোটা ঠাণ্ডা হলেই বিস্বাদ হয়ে যায়। কিন্তু বাকরখানি ঠাণ্ডা হলেও একইরকম মজা। সাতদিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায়। পুরনো ঢাকায় হাজারো পরিবার আছে যারা বংশ পরম্পরায় বাকরখানির কারিগর।
সকালে নাস্তার কথা মনে হলে যেমন বাকরখানির কথা মনে পরে। তেমনে সুস্বাদু বাকরখানির কথা বলতে গিয়ে এখনো ‘ঢাকাইয়ারা’ আগা বাকের ও খনি বেগমের অমর প্রেম কাহিনী স্মরণ করেন।