শনিবার   ০২ আগস্ট ২০২৫   শ্রাবণ ১৭ ১৪৩২   ০৭ সফর ১৪৪৭

মৃত তিমি যে কারণে বিস্ফোরিত হয়!

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৪:৪৯ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সোমবার

পৃথিবীর বড় প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম নীল তিমি। অনেক মানুষেরই তিমি সম্পর্কে জানার অনেক আগ্রহ থাকে। কখনো যদি সাগরের কুল ঘেঁষে কোনো তিমি দেখা যায়, অনেক মানুষই সেটা দেখার জন্য ভিড় জমায়। আবার অনেক সময় দেখা যায় মৃত তিমির দেহ সাগরের পানিতে ভেসে সাগরের কূলে চলে আসে। এটি দেখে আশেপাশে অনেকেই মৃত তিমির দেহ দেখার জন্য ছুটে আসে। কারণ কোনো মানুষই বিশাল এই প্রাণীটিকে খুব কাছাকাছি দেখবার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।

তবে বেশিরভাগ মানুষই জানে না, যখন একটি তিমি মারা গিয়ে সাগরের পানিতে ভেসে কূলে আসে তখন যেকোনো মুহূর্তে এর শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ বিস্ফোরিত হতে পারে। আর এই বিস্ফোরণ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে এবং এর ফলে তিমির অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রায় ৭০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা বেগে বাইরে বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ এটি আশেপাশের অঞ্চলের অনেক দূরে ভালোভাবেই ছড়িয়ে যায়। কোনো ব্যক্তি যদি সেই মুহূর্তে তিমিটির কাছে থাকেন তাহলে সেটি হবে তার জন্য খুবই বিপজ্জনক।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এরকম ঘটনা কেন ঘটে। কারণ যখন একটি তিমি মারা যায় তখন এটির রক্ত চলাচল ও শ্বাসক্রিয়া থেমে যায়। এর ফলে তিমির দেহের অভ্যন্তরে থাকা অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য বর্জ্য বাইরে বের করার কোনো উপায় থাকেনা। দেহের কোষগুলোতে এক ধরনের এসিডিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এতে দেহের অভ্যন্তরীণ কোষগুলো তাদের প্রকৃত গঠন হারায়, কোষঝিল্লিগুলো দুর্বল হয়ে যায়। তখন এই প্রাণীটির কোষ ভেঙে যায়। সে সময়ে শ্বসনতন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়াসমূহ তিমির অভ্যন্তরীণ লিপিড, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করে এবং খুব দ্রুত অধিক সংখ্যায় বংশবিস্তার করতে থাকে। যে প্রক্রিয়ায় ঘটনাটি ঘটে সেটিকে বলা হয় পিউট্রেফ্যাকশন এবং এর ফলে দেহের অভ্যন্তরীণ কোষ দ্রবণের ন্যায় হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বেশ কিছু গ্যাস যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রোজেন জমা হয়। গ্যাসগুলো মৃত দেহের অভ্যন্তরে থাকায় মৃতদেহটি স্ফীত হয়। যখন তিমির মৃতদেহের অভ্যন্তরের গ্যাসের চাপ খুব বেশি হয়ে যায় তখন এর ভেতরের তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ তিমির মুখ ও পায়ুপথ দিয়ে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে। তিমির দেহ অনেক বড় হওয়ায় এই চাপের পরিমাণ তুলনামূলক অনেক বেশি হয়। বিশাল এই প্রাণীটির ত্বকের নিচের ব্লাবার যেটি এই চাপকে দীর্ঘক্ষন ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাই যখন কোনো তিমির মৃতদেহ সমুদ্রতীরে পৌঁছায় তখন এটির মৃতদেহকে অনেক স্ফীত দেখা যায়।

তিমির দেহের ওজন অনেক বেশি হবার কারণে তা বেশি স্ফীত হয়ে দেহের বিভিন্ন ছিদ্র ছোট করে ফেলে। এটির জন্য সমস্যা আরো বেড়ে যায়। এসময় তিমির দেহের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত চাপ থাকলেও ভেতরের গ্যাসগুলো কোনো উন্মুক্ত বড় ছিদ্র না পাওয়ায় বাইরে বের হতে পারে না। এটির ফলে তিমির দেহের অভ্যন্তরের চাপ আরো বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে সেটি বিস্ফোরিত হয়ে দেহের বাইরে বেরিয়ে আসে। এ সময় এই অস্বাভাবিক বিস্ফোরণ থামানোর উপায় হচ্ছে বড় হাতল যুক্ত কোনো চাকু দিয়ে দূর থেকে তিমির দেহে একটি বড় ধরনের ছিদ্র করে দেয়া। তবে ২০০৩ সালে একই ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গেছে এই পদ্ধতিও বিপজ্জনক হতে পারে।

এরকম তিমির মৃতদেহ বিস্ফোরণের ঘটনা বেশ কয়েকবার দেখা গেছে। তাইওয়ানে পাওয়া এক মৃত তিমিকে তাদের এক গবেষণা কেন্দ্রে নিয়ে যাবার সময় তাইনান শহরে বিস্ফোরিত হয়। সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ১৯৭০ সালে ওরেগনে ঘটেছিলো। কিন্তু বিশাল এই বিস্ফোরণে মানুষেরও হাত ছিল। ওরেগন রাজ্যের তত্ত্বাবধায়নে থাকা কয়েকজন এই বিশাল মৃতদেহটিকে কিভাবে সরাবে তা ভেবে উপায় না পেয়ে এটিকে নিজেরাই বিস্ফোরণ করতে চায়। এজন্য প্রায় আধা টন ডাইনামাইট দিয়ে তারা তিমির মৃতদেহটি ঘিরে দেয়া হয়েছিল। যদিও একজন মিলিটারি ট্রেইনার তাদের বলেছিলো ডাইনামাইটের পরিমাণে অনেক বেশি। তবে উনাদের আশা ছিল যাতে তিমিটি পুরোপুরি টুকরো টুকরো হয়ে একদম হারিয়ে যায়। যেসব টুকরো বাকি থাকবে সেগুলো সীগালরা খেয়ে ফেলবে।

তবে ঘটনা যেমনটা হবার আশা ছিলো ঘটলো তার পুরো বিপরীত। সেই তিমিটির শত শত ব্লাবার শতশত টুকরো হয়ে গিয়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে থাকা প্রায় ৭৫ জন মানুষ ও যারা এই ঘটনাটি ভিডিও করতে এসেছিলো তাদের পড়তে হয়েছিলো এক বিপাকে। কারণ বড় ধরণের বিস্ফোরণে তিমির মৃতদেহ প্রায় ২৫০ মিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ার মতোই তিমির দেহের অংশগুলো পড়তে থাকে। এদের মধ্যে এক গাড়ির উপর বড় একটি ব্লাবার পড়ে তা একদম নষ্ট করে দেয়। যখন এই বিস্ফোরণটি শেষ হয় তখন যেসব সীগালদের আশা করা হয়েছিলো যে তিমির দেহের বাকি অংশ খেয়ে পরিষ্কার করবে তারাই সেখান থেকে অনেক দূরে চলে যায়। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এসব আবর্জনা পরিষ্কার করে।