সোমবার   ১৭ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ২ ১৪৩২   ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ভারোত্তোলনের ‘দাগ’ মিটবে কী করে?

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৪:৩৮ পিএম, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯ বুধবার

৩৬ বছর পর এশিয়ান গেমসে পদকহীন বাংলাদেশ। এত দিন মেয়েদের কাবাডি মুখরক্ষা করে চললেও এবার হতাশ করেছে তারাও। এশিয়ান গেমস কাভার করার পর দেশি-বিদেশি খেলোয়াড় ও কোচদের সঙ্গে কথা বলে এর কারণ ও ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙার উপায় বের করার চেষ্টা করেছেন রাহেনুর ইসলাম। আজ দ্বিতীয় কিস্তিতে থাকছে ভারোত্তোলন

চোখে অঝোরধারা। গলায় চকচক করছে সোনার পদক। মাবিয়া আক্তার সীমান্তের কান্নাই বলে দিচ্ছিল কত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে ভারোত্তোলনের মতো খেলায় উঠে আসতে হয়। ২০১৬ এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে সোনা জিতে তাঁর এমন কান্না ছুঁয়ে যায় ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়। তারকা বনে যান মাবিয়া। ভাসেন পুরস্কারবন্যায়। ক্রিকেট উন্মাদনার বাংলাদেশে ছোট খেলাগুলোর অনুপ্রেরণার নামই হয়ে যান সামান্য মুদি দোকানির মেয়ে মাবিয়া।

এটা গল্পের একটা পিঠ। অন্য আরেকটা পিঠ অনেকের অজানা। আসলে ৬৩ কেজি ওজনশ্রেণীর স্ন্যাচে মাবিয়া দ্বিতীয় হন ৬৭ কেজি তুলে। সেখানে ভারতের রিনা প্রথম হয়েছিলেন ৮৯ কেজি তুলে। ক্লিন অ্যান্ড জার্কে মাবিয়া থামেন ৮২ কেজিতে। তাই রিনা ৬১ কেজি তুললেই পেতেন সোনা। কিন্তু রিনা চেয়েছিলেন ১১০ কেজি তুলে ভারতীয় অন্য ভারোত্তোলকদের ছাড়িয়ে যেতে! সেটা হয়নি, তিনবারই তিনি ব্যর্থ। সৌভাগ্যে সোনা জিতে যান মাবিয়া। সামর্থ্যের প্রশ্নটা আসছে এখানেই।

মাবিয়া অবশ্য এসএ গেমস শেষে ১৪৯ কেজিতেই থেমে থাকেননি। গত বছর কমনওয়েলথ গেমসে তোলেন নিজের সেরা ১৮০ কেজি। তবে জাকার্তা এশিয়ান গেমসে ধরে রাখতে পারেননি সেটা। স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে তুলতে পারেন ১৭৮ কেজি। এ জন্য নিজের বদলে মাবিয়া দায় চাপালেন কর্মকর্তাদের ওপর, ‘আমি যতটুকু করেছি, সবটা নিজের চেষ্টায়। ফেডারেশনের কাছে একজন বিদেশি কোচের দাবি জানিয়েছিলাম। তারা দেয়নি।’

তাঁর ইভেন্টে অন্য পাঁচ প্রতিযোগী সবাই তুলেছেন ২০০ বা ২০০ কেজির বেশি! উত্তর কোরিয়ার কিম হায়ো সিম সোনা জিতেছেন ২৫০ কেজি তুলে। রুপাও একই দেশের চো হায়ো সিমের। তিনি তোলেন ২৩৮ কেজি। এই ইভেন্টে মেয়েদের বিশ্বরেকর্ড ২৬২ কেজি। এশিয়ান গেমস রেকর্ড ২৬১ কেজি। এর ধারেকাছেও নেই মাবিয়া। শুধু বিদেশি কোচ আর বছরজুড়ে অনুশীলন করলে কি ব্যবধান কমানো সম্ভব? জানতে চেয়েছিলাম জাকার্তায় মাবিয়ার ইভেন্টে সোনা জেতা কিম হায়ো সিমের কাছে। তাঁর চমৎকার ব্যাখ্যা, ‘উত্তর কোরিয়া বছরজুড়ে অনুশীলন করে ভারোত্তোলনে। ইরান, ইরাক, কাজাখস্তান, জাপান, ইংল্যান্ড, রাশিয়ার খেলোয়াড়রাও করে। বাস্তবতা হচ্ছে আমরা জন্মগতভাবে কিছুটা এগিয়ে। কোরিয়ান আর চাইনিজদের ছোট বাহু, ছোট পা কিন্তু চওড়া পিঠ। ভারোত্তোলনের জন্য আদর্শ শরীর। এই ব্যবধান অন্য যেকোনো কিছু দিয়ে কমানো কঠিন। পাশাপাশি আমাদের সরকারও খেলাটায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এ জন্যই উন্নতি করছি আমরা।’

খেলাটার প্রায় সব রেকর্ডই চীন বা কোরিয়ানদের। মাবিয়ার ইভেন্টেই যেমন বিশ্বরেকর্ড চীনের ডেং ওয়েইয়ের। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক থেকে চারটি সোনার তিনটি উত্তর কোরিয়া পায় ভারোত্তোলনে। সরকার খেলাটায় গুরুত্ব দেওয়ায় সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগেনি। বাংলাদেশে সরকারের সেই সাহায্যটুকু নেই ভারোত্তোলকদের জন্য। মাবিয়া চেয়েছিলেন বিদেশি কোচ, ফেডারেশন দিয়েছিল ২০১৬ এসএ গেমসের ব্রোঞ্জজয়ী সতীর্থ ফিরোজা পারভীনকে!

২০১৪ সালেই বাংলাদেশি ভারোত্তোলকদের ১৫ দিনের একটি কোর্স করাতে এসেছিলেন অবিনাশ পাণ্ডে। তিনি পরে কোচ হয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার। তাঁর হাত ধরে অলিম্পিকে রুপাও জিতেছে ইন্দোনেশিয়া। অবিনাশের মানের একজন কোচের দাবি ১৯৮৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা ২৪ বছর জাতীয় ভারোত্তোলনে সোনা জেতা বিদ্যুৎ কুমার রায়ের কণ্ঠেও, ‘ভালো মানের কোচ পেলে এসএ গেমসে আমারও সোনা থাকতে পারত। আমাদের অনুশীলনব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ গেমস চলার সময় দেখা যায়, গরমে ঘেমে নেয়ে খেলোয়াড়দের একাকার অবস্থা। রয়েছে প্লেটের সমস্যা, দুজন অনশীলন করলে বসে থাকতে হয় অন্যদের। কিন্তু জোর দিয়েই বলতে পারি, সুযোগ-সুবিধা পেলে এই খেলায় আমাদের সম্ভাবনা আছে।’

সব শেষ ২০১৬ সালে দ্বাদশ এসএ গেমসে ৪টি সোনা জিতে পঞ্চম হয়েছিল বাংলাদেশ, এর একটি মেয়েদের ভারোত্তোলনে মাবিয়া আক্তার সীমান্তের। ১৯ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হামিদুল ইসলাম ১১তম এসএ গেমসে ৭৭ কেজি ওজনশ্রেণিতে পেয়েছেন সোনা। সেবার দুটি করে রুপা ও ব্রোঞ্জ জিতেছিল বাংলাদেশের ভারোত্তোলকরা। তবে আন্তর্জাতিক মানে এখানেও বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ। হামিদুল স্ন্যাচে তোলেন ১১৯ কেজি, ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১৪৯ কেজি। স্ন্যাচের বিশ্বরেকর্ড ১৭৭ কেজি ও ক্লিন অ্যান্ড জার্কের ২১৪ কেজি! দুটো রেকর্ডই হয়েছে ২০১৬ রিও অলিম্পিক গেমসে। বিদেশি কোচ ও বছরজুড়ে অনুশীলনে এই ব্যবধান কি কমানো সম্ভব? জাকার্তায় ৬১ কেজি ওজনশ্রেণিতে এশিয়ান গেমসের সোনাজয়ী আর এই ইভেন্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইন্দোনেশিয়ার ইকো ইউলি ইরাওয়ান জানিয়েছিলেন, ‘আমি উঠে এসেছি লামপাংয়ের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে। ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় আমাদের দ্বীপে। পাহাড়ি হওয়ায় প্রকৃতিগতভাবে কিছুটা এগিয়ে আমি। এর সঙ্গে উন্নতি করেছি আধুনিক অনুশীলনে। কম ওজনের খেলাগুলোয় তোমরাও চেষ্টা করতে পারো পাহাড়িদের দিয়ে।’

সেই আন্তরিকতা কি আছে ভারোত্তোলন ফেডারেশনের? তা ছাড়া গত বছর এক নারী ভারোত্তোলককে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে খোদ ফেডারেশনের অফিস সহকারী সোহাগ আলীর বিরুদ্ধে। সম্ভাবনাময়ী সেই খেলোয়াড় পাগলপ্রায় হয়ে কাতরাচ্ছিলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। এমন অনিরাপদ ফেডারেশনে নিজেদের সন্তানদেন অভিভাবকরা পাঠাবেন কী করে? ২০১৬ সালে আবার অ্যাডহক কমিটি সময়মতো নির্বাচন না দেওয়ায় এশিয়ান ভারোত্তোলন ফেডারেশন নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশকে। সেই সমস্যা কেটেছে। কিন্তু ধর্ষণকাণ্ডে ভাবমূর্তিতে যে দাগ লেগেছে, সেটা মিটবে কিভাবে?