ড্রপা পাথরের অমীমাংসিত রহস্য
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৫:১১ পিএম, ২১ জানুয়ারি ২০১৯ সোমবার

বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক চি পো তেই প্রায়ই তার ছাত্রদের নিয়ে ইতিহাসের সন্ধানে বের হতেন। বিভিন্ন পর্বতের গুহা ঐতিহাসিক স্থাপনা, মন্দির প্রভৃতি স্থানে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান করতে। তেমনই ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে তিনি একদল ছাত্রসহ তিব্বত সীমান্তে অভিযানে বের হন। তিব্বতের বায়াঙ্কারা উলা পর্বতের বেশ কিছু গুহা পর্যবেক্ষণ করছিলেন তিনি। হঠাৎ কয়েকজন ছাত্র এক অদ্ভুত গুহার সন্ধান লাভ করেন। গুহাটি বাইরে থেকে দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগছিল। গুহার দেয়াল বেশ মসৃণ ছিল। বসবাসের উপযোগী করে তুলতে কারা যেন যন্ত্রপাতি দিয়ে পাথর কেটে মসৃণ করে তুলেছে। তারা অধ্যাপককে সেই গুহার ব্যাপারে অবগত করেন। তিনি দল বল নিয়ে গুহার ভেতরে প্রবেশ করেন।
গুহার ভেতরটা বেশ উষ্ণ ছিল। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে তারা বেশকিছু সারিবদ্ধ কবরের সন্ধান পান। প্রায় চার ফুট চার ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের কবরগুলো খনন করতেই বেরিয়ে এল মানুষের হাড়। কিন্তু কঙ্কালের মাথার খুলিসহ বিভিন্ন হাড় স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় আকারে বেশ ছিল। কার মাথার খুলি এত বড় হতে পারে? একজন ছাত্র বলে উঠল হয়তো এগুলো কোন গরিলা কিংবা উল্লুকের মাথা। কিন্তু অধ্যাপক এটি পছন্দ করলেন না। কারণ একটা উল্লুককে কারা এত যত্ন করে সমাধিস্থ করবে।
কবরের বুকে কোনো নামফলক ছিল না। তাই এগুলো কাদের কবর হতে পারে তা জানার কোনো সুযোগ ছিল না। অধ্যাপকের নির্দেশে ছাত্ররা গুহাটিকে আরো ভালো করে খুঁজে দেখতে লাগল। এক পর্যায়ে তারা এক ফুট ব্যাসার্ধের শত শত পাথরের চাকতির সন্ধান পান। পাথরের গায়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয় বস্তু যেমন সূর্য, চন্দ্র, পাখি, বৃক্ষ প্রভৃতির জিনিস বেশ যত্ন করে খদাই করা ছিল। অধ্যাপক চি পো তেই প্রায় কয়েক 'শ চাকতি নিয়ে বেইজিংয়ে ফেরত যান। তিনি অন্যান্য অধ্যাপকের নিকটে এই অনুসন্ধান সম্পর্কে বিবৃতি প্রদান করেন।
তার হিসাব অনুযায়ী চাকতিগুলো প্রায় ১২ হাজার বছরের পুরানো। ধীরে ধীরে চীন ছাড়িয়ে পুরো পৃথিবীতে এই পাথরের চাকতির গল্প ছড়িয়ে পড়ে। গবেষকগণ এই পাথরের চাকতির নাম দেন ড্রপা পাথর। ড্রপা পাথরের গায়ের সাংকেতিক চিহ্নের উদ্ঘাতনের জন্য গবেষণা শুরু হয়। আর পৃথিবীবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। সবাই জানতে চাই পাথরের গায়ে হাজারও সংকেতের মাঝে কোন অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে। ড্রপা পাথরের ড্রপা নামের আবিষ্কারক বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের রহস্যময় গবেষক সুম উন নে, ড্রপা পাথরের আবিস্কারের প্রায় ২০ বছর পর তিনি গবেষণা শুরু করেন। প্রায় চার বছরের গবেষণার শেষে দুরবেদ্ধ ড্রপা পাথরের রহস্য সমাধান করতে সক্ষম হন তিনি। তিনি এক জার্নালের মাধ্যমে দাবি করেন, পাথরের গায়ে এক হাইয়ারগ্লাফিক বর্ণ দারা ড্রপা নামের কোন এক জাতির সফরনামা লিখিত রয়েছে। ভিনগ্রহী বা এলিয়েন শব্দটা শোনা মাত্রই সবার টনক নড়ে ওঠে। সবাই আগ্রহী হয়ে ওঠে এই পাথরে চাকতির ব্যাপারে। কি বলতে চাই লোকটা এটা এলিয়েনদের কারসাজি না কি।
আরেক অধ্যাপক ছুম উন নে এর মতে এটা ভিনগ্রহীদের কারসাজি। তিনি একটা চাকতির সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন। তার অনুবাদ এর মর্মার্থটা হচ্ছে, আমরা অর্থাৎ ড্রপারা মেঘের উপর থেকে মহাকাশযানে চড়ে মাটিতে অবতরণ করি। আমরা আমাদের সন্তানেরা এই গুহায় প্রায় দশ সূর্য দয় পর্যন্ত লুকিয়ে থাকি। কয়েক দিন পর যখন আমরা স্থানীয়দের দেখা পাই তখন তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। ইশারায় যোগাযোগ করতে সক্ষম হওয়ায় আমরা এখান থেকে বেরিয়ে আসি। এরপর থেকেই চাকতিগুলো ড্রপা পাথর নামে পরিচিতি লাভ করে।
সুম উন নে ১৯৬২ সালে তার গবেষণা সম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। কিন্তু তার গবেষণার ফলাফল অন্যান্যরা মেনে নেয় নি। তার অনুবাদেও যথেষ্ট অসঙ্গতি ধরা পড়ে। ইতিহাসবিদ এবং পুত্নতাত্তিকগনদের ছুরে দেয়া বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হন তিনি। জানা যায়, তিনি ব্যর্থতা দায় মাথায় নিয়ে জাপানে নির্বাসনে চলে যান। এর অল্প কিছু দিনের পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে ১৯৬৮ সালে ড্রপা পাথর রুশ বিজ্ঞানীরা নিয়ে একটি গবেষণাগারে স্থানান্তরিত করে। চাকতির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা চালান। তাদের মতে পাথর এর গঠন ও অন্যান্য পাথরের চেয়ে আলাদা।
পাথরগুলো একধরনের গ্রানাইট পাথর। যার মধ্যে কোবাল্টের পরিমাণ অনেক বেশি। কোবাল্টের উপস্থিতি পাথরের স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত শক্ত করে। সাইজেভের মতে প্রাচিনকালে এমন কোনো পদ্ধতি ছিল না যা দিয়ে প্রাচীনকালে এমন কোন পাথরের উপর খোদাই করা সম্ভব হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে ড্রপার রহস্য আরও ঘনীভূত হতে থাকে। একটা সময় দেখা গেল অধ্যাপক চি পো তেই সহ সকল গবেষকরা যারা এই পাথরের গবেষণা নিয়ে কাজ করেছে তাদের গবেষনা এবং অস্তিত্ব নিয়ে পুরাতত্ত্ববিদরা সন্ধিহান হয়ে পরেন।
ড্রপা পাথর আবিষ্কারের সময় তিব্বতে দুই জাতির বসবাস ছিল। কিন্তু তাদের ইতিহাসের কোথাও এরূপ ভিনগ্রহীর কোন ঘটনার উল্লেখ নেই। আর ড্রপারা নিঃসন্দেহে মানুষ। ভিনগ্রহের কোন প্রজাতি নয়। ড্রপা পাথর নিয়ে বহু গবেষণা হলেও নানা বিতর্কে কারণে গবেষণার অগ্রগতি একদম শুন্যই বলা যায়। ড্রপা পাথর নিয়ে রহসস্যের কোনো সমাধান না হলেও হয়তো এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অজানা থেকে যাবে। আর পুরো ব্যাপারটি যদি বানোয়াটও হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের মাধ্যমে সেই রহস্যের ইতি টানা হোক।