ভয়ঙ্কর ভাইরাস `চিকুনগুনিয়া’!
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৮:৩৬ পিএম, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ শনিবার

চিকুনগুনিয়া শব্দটি এসেছে আফ্রিকার সোয়াহিলি বা মাকুন্দে ভাষা থেকে। শব্দটার অর্থ বেঁকে যাওয়া। এ রোগে ব্যথায় শরীর কুঁকড়ে যায় বলেই এই নাম। কঙ্গোতে অবশ্য এই রোগের নাম বুকা বুকা। যার অর্থ ভাঙা ভাঙা। মানে শরীরের হাড্ডিগুলো যেন মনে হয় ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে! নামের যে মাহাত্ম্য,তা কেবল ভুক্তভোগীরাই টের পান।
নামকরণের ইতিহাস থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এ রোগের আমদানি সুদূর আফ্রিকা থেকে। রোগটার প্রথম আবির্ভাব ১৯৫২ সালে। তানজানিয়ার নেওয়ালা জেলার সোয়াহিলি গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে প্রথম ছড়িয়েছিল এই রোগ। রবিনসন ও লামসডেন নামক দুই বিজ্ঞানী প্রথম ১৯৫৫ সালে নতুন প্রজাতির এই ভাইরাসকে শনাক্ত করেন এবং স্থানীয় ভাষা অনুসারে এর নাম রাখেন চিকুনগুনিয়া। কয়েক বছরের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকা পেরিয়ে এশিয়া ও ইউরোপে। এশিয়ার প্রথম আক্রান্ত দেশটি হলো থাইল্যাণ্ড; ১৯৫৮ সালে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এ দেশে। তারপর একে একে ছড়ায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায়।
২০০১ সালে মহামারি আকারে দেখা দেয় ভারত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে (মরিশাস, মাদাগাস্কার, রিইউনিয়ন)। তারপরই ২০০৬ সালে ভারতের বিভিন্ন শহরে চিকুনগুনিয়ার প্রলয়ঙ্কারী মহামারী দেখা দেয়। বলা হয়, সে সময় ভারতে প্রায় ১.৪২ মিলিয়ন মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রায় অচল ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল। এটা সরকারি হিসাব। সত্যিকারের আক্রান্তের সংখ্যা পত্র-পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী এর চেয়ে অনেক বেশি। তত দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিকুনগুনিয়াকে ট্রপিকাল ডিজিজ বা গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার রোগ হিসেবে বর্ণনা করা বাদ দিয়েছে। কেননা ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তো বটেই, ২০০৩ সালে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এবং সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকা মহাদেশে। চিকুনগুনিয়াবাহী মশা বিমানে করে পাড়ি দিয়েছে মহাদেশের পর মহাদেশ আর সত্যিকার অর্থেই যেন মেরুদণ্ড গুড়িয়ে দিচ্ছে মানবজাতির।
সাম্প্রতিক এ ভাইরাস সংক্রান্ত মহামারী থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বোঝা যায়, চিকুনগুনিয়া জ্বরের ফলে ক্রনিক পর্যায়ে ছাড়া তীব্র অসুস্থতাও হতে পারে। তীব্র অসুস্থতার পর্যায়কে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে- পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে এর প্রথম পর্যায়ে ভাইরাস রক্তের মধ্যে প্রবেশ করে, পরবর্তীতে শেষ ধাপে স্বাস্থ্য পুনরূদ্ধারকারী পর্যায়ে পৌঁছায় যে সময়টি দশ দিন স্থায়ী হয়। এ পর্যায়ে ভাইরাস রক্তে শনাক্ত করা যায় না। সাধারণত এই রোগটি শুরু হয় হঠাৎ করেই শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে যা সাত থেকে দশ দিন পর্যন্তও স্থায়ী হয়। জ্বর সাধারণত ৩৯ °সে (১০২ °ফা) বা মাঝে মাঝে ৪০ °সে (১০৪ °ফা) পর্যন্ত হয়ে থাকে—কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং আস্তে আস্তে কমতে থাকে। রক্তে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সাথে জ্বর আসে এবং রক্তে ভাইরাসটির মাত্রা যতই তীব্র পর্যায়ে পৌঁছায় লক্ষণগুলোর তীব্রতাও সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভাইরাসটির রক্তে প্রবেশের পর যখন আইজিএম নামে একটি এন্টিবডি রক্তস্রোতের মধ্যে বাইরের থেকে প্রবিষ্ট রোগজীবাণু-প্রতিরোধক পদার্থ সৃষ্টি করে তখন এর প্রভাব কমতে শুরু করে। যাইহোক, মাথা ব্যথা, অনিদ্রা এবং তীব্র অবসাদ সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিন থেকে যায়।
১১ দশমিক ৬ কেবি (কিলো বেইস পেয়ার) লম্বা এই জীবাণু এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস। টগাভিরিডি পরিবারের সদস্য। এ পর্যন্ত তিন ধরনের জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট আবিষ্কৃত হয়েছে এই ভাইরাসের। ওয়েস্ট আফ্রিকান, ইস্ট সেন্ট্রাল সাউথ আফ্রিকান আর এশিয়ান। আমাদের দেশে যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে সেটা এশিয়ান প্রজাতি। এডিস এজিপ্টি নামের মশা এই ভাইরাসকে বহন করে। চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ানোর মাধ্যমে মশা নিজেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। পরবর্তী সময়ে আরেকজনকে কামড়ায় ও তার শরীরে ভাইরাস ঢুকে। এভাবে রোগের বিস্তার ঘটতে থাকে। মশার মাধ্যমে ভাইরাস মানুষের রক্তে প্রবেশ করার পর ঠিক কী উপায়ে দেহের কোষগুলোকে আক্রমণ করে, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। মনে হচ্ছে, এই প্রক্রিয়া বেশ জটিল।
এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়াকে প্রতিহত করার মতো কোনো অস্ত্র হাতে নেই মানুষের। উপসর্গ উপশমকারী চিকিৎসাই একমাত্র ভরসা। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ৪০০ ব্যক্তির উপর চিকুনগুনিয়া টিকার ফেজ ২ ট্রায়াল এখনো চলছে। ট্রায়াল শেষ না হওয়া অবধি টিকার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ করা যাবে কি না সে বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না!