বৃহস্পতিবার   ১৫ মে ২০২৫   জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩২   ১৭ জ্বিলকদ ১৪৪৬

মাসিক ব্যবস্থাপনার অভাবে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে ৪০ শতাংশ ছাত্রী

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৭:০০ পিএম, ১০ জানুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার

দেশের বেশিরভাগ স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট না থাকায় প্রতি ৪০ ভাগ ছাত্রীকে প্রতি মাসে স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে হয়। ফলে তারা একদিকে ক্লাসে পিছিয়ে পড়ে অন্যদিকে পরীক্ষার ফল খারাপ হয়।

 

'বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজেন বেজলাইন সার্ভে ২০১৪', আইসিডিডিআরবির জরিপ ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে সেছে।

'বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজেন বেজলাইন সার্ভে ২০১৪'-তে বলা হয়েছে, ৪০ শতাংশ ছাত্রী তাদের মাসিককালীন সময়ে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। ওই সার্ভেতে মাসিককালীন স্বাস্থব্যবস্থাপনাকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে স্কুলপর্যায়ে সমস্যা প্রকট বলে উল্লেখ করা হয়।

সার্ভেতে দেখা গেছে, বয়ঃসন্ধি বা প্রথম মাসিকের আগে মাত্র ৩৬ শতাংশ ছাত্রী বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে। ফলে তারা যখন জীবনের এই অধ্যায়ে পা রাখে তখন চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। কী করতে সে জ্ঞান না থাকা এবং স্কুলে ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেট না থাকায় তারা স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়।

অজ্ঞতার কারণে বেশিরভাগ মেয়েরা মাসিকের সময়কে অসুস্থতার সময় হিসেবে গণ্য করে। তারা মনে করে, এই সময়ে নারীরা অসুস্থ থাকে। এ জন্য স্বাভাবিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হয়।

অন্যদিকে মাসিকের সময়ে ৮৫ শতাংশ ছাত্রী পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। কাপড় ব্যবহারের সঠিক নিয়ম না জানা এবং বাজারে বিক্রি হওয়া প্যাডের চড়া মূল্যের কারণে ছাত্রীদের পক্ষে সঠিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অবলম্বন করা সম্ভব হয় না।

এ বিষয়ে ২০১৫ সালের ২৩ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। পরিপত্রে স্কুলে মাসিকবান্ধব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়। তার মধ্যে ছিল- স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করা, প্রতিটি স্কুলে একজন নারী শিক্ষককে মাসিককালীন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব দেয়া, ছাত্রীদের ক্রয়ের জন্য স্কুলে প্যাড ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা করা এবং টয়লেটে পর্যাপ্ত সাবান ও পানির ব্যবস্থা রাখা।

কিন্তু সরকারি ওই নির্দেশনা এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ উন্নয়ন সংস্থাগুলোর। সরেজমিনেও দেখা যায় শিক্ষা মন্ত্রণায়ের পরিপত্র বাস্তবায়ন হয়নি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) সহকারী কো-অর্ডিনেটর (ট্রেইনিং সেল) নাসরিন বেগম বলেন, দেশে বর্তমানে প্রতি ১৮৭ শিক্ষার্থীর জন্য একটি টয়লেট রয়েছে। কিন্তু সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ৫০ জনের জন্য একটি টয়লেট থাকার কথা।

২০১৩ সালে আইসিডিআরবির এক জরিপে দেখা যায়, মাসিককালীন সময়ে ৮২ শতাংশ মেয়ে পুরনো কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করে। মাত্র ১ শতাংশ মেয়ে মানসম্পন্ন প্যাড ব্যবহার করে।

এ বিষয়ে ‌বেসরকারি সংস্থা 'রিপ্রোক্টিভ হেলথ সার্ভিস ট্রোইনিং অ্যান্ড এডুকেশন প্রোগ্রাম' এর সহকারী পরিচালক ড. এলভিনা মুস্তারি বলেন, নারী ও মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মাসিক একটি প্রাকৃতিক বিষয়। এটা কোনো অসুস্থতা না। এ সময় মেয়েদের কিছু ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা, একটু দুর্বলতা অনুভব করা, মাথা ব্যথা বা অস্বস্তি হতে পারে। এসব কারণে এই সময়ে অনেক মেয়ে নিজেকে অসুস্থ মনে করে ঘরের বাইরে যেতে চায় না।

২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস এর দুতাবাসের অর্থায়নে ঋতুপ্রকল্প মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্যকাজ করে যাচ্ছে। ঋতু প্রকল্পে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক আন্তর্জাতিকউন্নয়ন সংস্থা সিমাভি লিড, রেড অরেঞ্জ মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশনস স্ট্র্যাটেজিক এন্ড কমিউনিকেশন পার্টনার,নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা টিএনও পার্টনার হিসেব আছে।এছাড়াও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন পার্টনার হিসেবে কাজ করছে বিএনপিএস এবং ডিওআরপি।

এ বিষয়ে রেড অরেঞ্জ মিডিয়া এণ্ড কমিউনিকেশনস এর হেড অব প্রোগ্রামস নকিব রাজিব আহমেদ বলেন, ঋতু প্রকল্প বর্তমানে নেত্রকোনা জেলার ৮টি উপজেলায় কাজ করছে। মাসিককালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও এই সময়ে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার জন্য করণীয় বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে রেড অরেঞ্জ।

তিনি বলেন, আমরা স্কুলগুলোতে মাসিকবান্ধব টয়লেট নিশ্চিত করতে কাজ করছি। কারণ মাসিকবান্ধব টয়লেট না থাকায় ছাত্রীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রতিটি স্কুলে ছাত্রীদের জন্য মাসিকবান্ধব আলাদা টয়লেট নিশ্চিত করা হচ্ছে বলে বহু আগেই জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

শিক্ষামন্ত্রী গণমাধ্যমকে, আমরা ছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সরবরাহ করছি। আমরা অনেক পুরাতন স্কুলে ছাত্রীদের জন্য নতুন করে টয়লেট নির্মাণ করছি।

স্কুলগুলোতে মেয়েদের স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক ব্যবস্থাপনা ও স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করে ডর্প নামে একটি এনজিও। সংস্থাটির পরিচালক (গবেষণা ও পরিকল্পনা) জুবায়ের হাসান বলেন, ‘এসডিজির চার নম্বর গোলে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের বিষয়টি আছে। এ কারণেই সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে পরিপত্র জারি করেছে। কিন্তু এটি নিশ্চিত করতে হলে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সচেতন হতে হবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, যথেষ্ট গোপনীয়তা এবং মেয়েদের জন্য আলাদা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উপযোগী টয়লেট মাসিক চলাকালীন সময়ে ছাত্রীদের স্কুলে আসা ও শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ নিশ্চিত করে। তাই সরকারি ও বেসরকারি সকল পর্যায়ে এ সম্পর্কে যথেষ্ট সহযোগী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।