বৃহস্পতিবার   ১৫ মে ২০২৫   জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩২   ১৭ জ্বিলকদ ১৪৪৬

এইচআইভি এইডস ঝুঁকিতে নারীরা

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৬:৫৮ পিএম, ১০ জানুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার

দুই মেয়ে, স্বামী নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে রেহানার সংসার। সব মেয়ের মতো ও একটি সুখী পরিবারের স্বপ্ন দেখেছিল। দুই মেয়েকে নিজের মনের মতো গড়ে তুলতে চেয়েছিল।

পাশাপাশি সংসারের সচ্ছলতার জন্য নিজেও কিছু একটা করার চেষ্টা করত। কারণ রিকশাচালক স্বামীর একার আয়ে চারজন মানুষের খরচ চালিয়ে মেয়েদের পড়াশোনা করানো কষ্টকর হয়ে উঠছিল।

রেহানা বলেন, মাঝে মাঝেই টাকা দিতে বাহানা করত। এটা-ওটা বলে বুঝ দিত। সরল মনে বিশ্বাস করতাম। তখনও বুঝতে পারিনি আমার স্বামী শিরায় মাদক নেয়। আমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী।

আমাকে বিয়ে করার আগে স্বামী একটা বিয়ে করেছিল। প্রথম স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। আমার গরিব বাবা-মা ভাবেন মেয়ে বড় হয়েছে। মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। অভিভাবকের পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হল আমার। বিয়ের বছর খানেকের মধ্যে মেয়ের জন্ম হল। মাঝেমধ্যেই স্বামী বাড়ি ফিরত না। জিজ্ঞেস করলে এটা-ওটা বলত।

স্বামী আমাকে মিথ্যা কথা বলবে এটা মনেও আসত না। বরং ভাবতাম, মানুষটা আমাদের জন্য কত কষ্ট করছে। তার পাশে আমি না দাঁড়ালে কে দাঁড়াবে? আমাদের সামনে তাকে কোনোদিন শিরায় মাদক নিতে দেখিনি। দিনে দিনে তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিজে নিজে ডাক্তার দেখায়। তার রক্তে এইচআইভি পজেটিভ ধরা পড়ে ২০০৪ সালে।

এই সত্যিটিও আমার কাছে গোপন করে। মরণব্যাধি এই রোগ নিয়ে দিনের পর দিন আমার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখছে। কনডম ব্যবহার করে নাই।

আমি দ্বিতীয়বার গর্ভবতী হই। কোলজুড়ে আসে দ্বিতীয় মেয়ে। দ্বিতীয় মেয়ের জন্মের পর আমার শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। ২০০৮ সালে আমার রক্ত পরীক্ষা করা হয়। রক্ত পরীক্ষায় আমার এইচআইভি পজেটিভ ধরা পড়ে। তখনই জানতে পারলাম স্বামীর কাছ থেকে উপহার স্বরূপ আমি মরণব্যাধি এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি।

আমার স্বামী তার প্রতি বিশ্বাসের এই মূল্য আমাকে দিল। দুই মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। ওদের রক্তে এইচআইভি ভাইরাস পাওয়া যায়নি। কিন্তু সমাজ যদি জানতে পারে তাদের বাবা-মা এইচআইভি ভাইরাস বহন করছে।

তখন আমার মেয়েরা কোথায় যাবে? তারা কি স্বাভাবিক মানুষের মতো সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে!

সন্ধ্যায় ঢাকার পান্থপথের ফুটপাতে প্রায়ই দশ-এগারো বছরের দুজন মেয়েশিশু বসে থাকে নইলে হাঁটাহাঁটি করে। বেলা পর্যন্ত ওরা ফুটপাতে ঘুমায়। কথায় কথায় তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ফুটপাতে থাক কেন? কি খাও?

প্রথমটির উত্তর না পাওয়া গেলেও দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল বেটারা টাকা দেয়। ওদের নিরাপত্তার জন্য কাঁঠালবাগান বাজারে সাজেদা ফাউন্ডেশনে রাতে থাকার প্রস্তাব দেয়া হয়।

কিন্তু তারা দুজনেই যেতে রাজি হয় না। রাতে রাস্তায় থাকা নিরাপদ নয় বললেও তাদের চোখেমুখে নিরুত্তাপ ভাব ফুটে ওঠে। ওদের আচরণে বোঝা যায়, রাস্তায় থাকতেই ওরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

কখনও ফার্মগেট, কখনও পান্থপথ অথবা অন্য কোনো এলাকার ফুটপাতই ওদের ঠিকানা। এতটুকু বয়সেই ওরা অনিরাপদ পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। অনিরাপদ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

ওরা জানে না অরক্ষিত যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে এইচআইভি/এইডস এ আক্রান্ত হতে পারে। নিরাপদ শারীরিক সম্পর্কের জন্য কনডম ব্যবহারের কথা প্রচারণা করা হলেও ওরা এ বিষয়ে অবগত নয়। এ কারণে বিদেশ ফেরত স্বামী, শিরায় মাদক নেয়া ব্যক্তির মাধ্যমে ফুটপাত, হোটেলের যৌনকর্মী অথবা তাদের স্ত্রীরাও এইচআইভি /এইডস এ আক্রান্ত হচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় এইডস বিষয়ক কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নজরুল ইসলাম বলেন, হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে অরক্ষিত যৌন সম্পর্কের ঘটনা ঘটছে।

সেগুলো আমাদের কার্যক্রমের আওতায় নেই। সেখানে কনডম সরবরাহ কর্মসূচি নিতে হবে। এমনকি বিদেশ থেকে যারা দেশে আসছেন তারা যে এইচআইভি সংক্রমিত তা অনেকেই জানেন না।

বিদেশ থেকে দেশে ফেরা লোকদের এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত করার প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে। এর ফলে অনেক নারীর জীবন বেঁচে যাবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সীর মতে, ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এখানে এইচআইভি শনাক্ত করা হয়েছে ৬২ ব্যক্তির। তাদের মধ্যে নারী ১৫, পুরুষ ৪৭ এবং ২ জন ছেলেশিশু রয়েছে।

এখানে সি ডি ফোর ও ভাইরাল লোড দুটি পরীক্ষা করা হয়। এইচআইভি পজিটিভ কোনো নারী গর্ভবতী হলে তাদের গর্ভের সন্তানের এইচআইভি সংক্রমণের হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ হওয়ার আশংকা থাকে।

সেজন্য আর্লি ইনফেন্ট ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা করান হয়। বাচ্চার বয়স ছয় সপ্তাহ হলে বলে দেয়া যায় সে এইচআইভি পজিটিভ কিনা। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যে শ্রমিকরা কাজ করছেন প্রতি বছর তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়লেই তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরিবার, সমাজের কাছে তারা তথ্য গোপন করে।

এখানে কোনো মেশিনারিজ বা প্রোগ্রাম নেই তা দিয়ে তাদের দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো। এর ফলে এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্ত শ্রমিকদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তারা সব জেনেও স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করেন। তাদের সন্তান হয়। তার মাধ্যমে স্ত্রী, এমনকি সন্তানও এইচআইভি পজিটিভ হয়।

এইচআইভি পজিটিভ রোগীর মধ্যে অভিবাসী শ্রমিক প্রায় ৫০ শতাংশ। যাদের মাধ্যমে স্ত্রী-সন্তানও এইচআইভি পজিটিভ হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে আগত এই প্রবাসী শ্রমিকদের যদি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হতো তাহলে অনেক জীবন বেঁচে যেত।

কিন্তু এখানে দুটি সমস্যা রয়েছে। একটি সামাজিক আরেকটি মানবাধিকারের। এর ফলে অনুমতিবিহীনভাবে কাউকে এইচআইভি পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপপরিচালক ও এইডস/ এসটিডি প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. বেলাল হোসেনের মতে, সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইডস সংক্রমণের হার .০১ শতাংশের মতো। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ যৌনকর্মী, হিজড়া এবং যারা শিরার মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে তাদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ৩.৯ শতাংশের মতো।

ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার মধ্যে শিরার মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীদের এইচআইভি সংক্রমণের হার বেশি। ২০১৭ সালে নতুন করে এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮৬৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ১২৫ জন। জীবিত রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৬৬২ জন। তার মধ্যে পুরুষ ৩ হাজার ৯৫ এবং নারী ১ হাজার ৫৬৭ জন।

সরকার এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত হতে পারে এমন ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় এইডস কন্ট্রোল প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশের ২৩টি জেলার ২৫টি জেলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা সদর হাসপাতালে বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা ও কাউন্সেলিং (এইচটিসি) করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

এরমধ্যে ৭টি হাসপাতালে এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিনামূল্যে সার্বিক চিকিৎসাসেবা ও এন্টিরেট্টোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) প্রদান করা হচ্ছে। ইউনিসেফের সহায়তায় ‘প্রিভেনশন অব মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন’ এর কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য এইচআইভি সংক্রমিত মা থেকে সন্তান যেন এইচআইভি সংক্রমিত না হয়।

কারণ একজন এইচআইভি পজিটিভ গর্ভবতী থেকে তার সন্তানের এইচআইভি সংক্রমিত হওয়ার হার ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ। আমাদের দেশে এইচআইভি পজিটিভ মা থেকে সন্তানের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ১.০৯ শতাংশ।

২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত ৯১ জন এইচআইভি পজিটিভ মা ৯২ জন শিশুর জন্ম দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন মা যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। জন্মগত ত্রুটি ও কম ওজনের শিশু ও অন্যান্য কারণে ৩ জন শিশু মারা গেছে। ৮৮ জন সুস্থ শিশু এবং ১ জন শিশু এইচআইভি পজিটিভ।

কেয়ার বাংলাদেশ’র জিএফপিডব্লিউআইডি প্রোজেক্ট হেলথ ইউনিটের টিম লিডার আবু তাহেরের মতে, এ বছর নারায়ণগঞ্জে শিরার মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে এমন ২১৬ ব্যক্তির এইচআইভি এইডসের জীবাণু রয়েছে কিনা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। তাদের মধ্যে ৪৩ জন পুরুষ ও একজন নারী এইচআইভি/এইডস শনাক্ত হয়েছে।

২০১৫ সালে গ্লোবাল ফান্ডের অর্থ সহায়তা বন্ধ হওয়ায় এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে এই কেন্দ্র আবার চালু হয়েছে। তিন বছরে এইচআইভি সংক্রমণের হারও বেড়েছে। ৩০ হাজার শিরার মাধ্যমে মাদক নেয়।

ভাসমান যারা শিরার মাধ্যমে মাদক নেয় সরকার তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার ব্যবস্থা করলে তাদের মাধ্যমে এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের ঝুঁকিটা কমে যেত। কারণ একই সিরিঞ্জে কয়েকজন মাদক গ্রহণ করায় এইচআইভি সংক্রমণের হার বাড়ছে। এর ফলে নারী-পুরুষ উভয়েই এইচআইভি ঝুঁকিতে রয়েছে।

অন্যদিকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যারা কাজ করতে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত অভিবাসীরা এইচআইভি/এইডসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মাধ্যমে স্ত্রীরা এইচআইভিতে সংক্রমিত হচ্ছেন। আক্রান্ত মা থেকে গর্ভের সন্তান সংক্রমিত হচ্ছে। এর ফলে নারীরা এইচআইভি ঝুঁকিতে রয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর একটি অপারেশনাল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এমসিএইচ-এর আলোকে নয়টি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

এরমধ্যে রয়েছে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু কমান, যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে যে রোগ ছড়ায় ইত্যাদি। ১০ থেকে ১৯ বছরের কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্যের আলোকে তথ্য, সেবা এবং নির্দেশ এই তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় স্ট্যাডিজি ২০১৭-২০৩০ এর আলোকে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

এরমধ্যে কৈশোরবান্ধব যৌনস্বাস্থ্য, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এ জন্য বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে ঢাকা শহরের ভাসমান ঝুঁকির্পূণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে এইচআইভি/এইডস সম্পর্কিত সচেতনতামূলক বার্তা স্বাস্থ্যসেবীদের মাধ্যমে পৌঁছানো হচ্ছে।

এছাড়া পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর থেকে এইচআইভি শনাক্ত করার কোনো প্রোগ্রাম নেই। তবে এইচআইভি পজিটিভ মাকে তার সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো অথবা এক মাসের বেশি না খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। কারণ তিনি এইচআইভি পজিটিভ হওয়ায় তার সন্তান এইচআইভি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বুকের দুধের মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে মাল্টিসেক্টরাল ভিত্তিতে কাজ করে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা তৈরি করলে এইচআইভি ঝুঁকির মাত্রা কমে যাবে জানালেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের এমসিএইচ এর সহকারী পরিচালক মো. মনজুর হোসেন।