বাংলার লুথার কিং’র ঐক্যের ডাক
হাসান মাহমুদ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:১৩ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ শনিবার
দেশ যখন ধ্বংসস্তূপের দ্বারপ্রান্তে, দিনদুপুরে মানুষ ঘর থেকে যখন বের হতে ভয় পায়, অফিস ও রাজপথে মব সন্ত্রাস; গুলি-বিশৃঙ্খলা তখন দেশকে রক্ষার জন্য জনতার প্রিয় নেতা তারেক রহমান (৬০) লন্ডনে ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে ফিরেছেন। তিনি ঢাকার পূর্বাচলের ৩শ’ ফিট সড়কের বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে শান্তির ডাক দিয়েছেন ২৫ ডিসেম্বর বিকেলে। ভাষণে তিনি কোন বিদ্বেষ, হিংসা, প্রতিশোধ না ছড়িয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, নিরাপদ দেশ গড়া নিয়ে লাখ লাখ জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান’। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের কথা স্মরণ করে তারেক রহমান বলেন, ‘তাঁর একটি বিখ্যাত ডায়ালগ আছে- ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম। আজ বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিএনপির একজন সদস্য হিসেবে আপনাদের সকলের সামনে আমি বলতে চাই- ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান ফর দ্য পিপল অব মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি।’ তাঁর এই পরিকল্পনায় দেশের মানুষের স্বার্থে, দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন জন্য বাস্তবায়ন করতে প্রত্যেক মানুষের সহযোগিতা লাগবে উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আপনারা যদি আমাদের পাশে থাকেন, আমাদের সহযোগিতা করেন, ইনশাআল্লাহ আমরা ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবো। আমরা সকলে যদি ঐক্যবদ্ধ হই, যদি সকলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, তাহলে লাখ-কোটি মানুষের প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে পারি ইনশাআল্লাহ। আমরা চাই সকলে মিলে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলবো, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন একজন মা দেখেন। একটি নিরাপদ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলাদেশে একজন নারী, একজন পুরুষ, একজন শিশু- যেই হোক না কেন নিরাপদে ঘর থেকে বের হলে যেন নিরাপদে ইনশাআল্লাহ ঘরে আবার ফিরে আসতে পারে’।
জননেতা তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আজ তাদের মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধার করতে চায়। কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে চায়। গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। মানুষ চায় তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার পাবে। আজ আমাদের সময় এসেছে সকলে মিলে দেশ গড়ার। এই দেশে যেমন পাহাড়ের মানুষ আছে, একইভাবে সমতলের মানুষ আছে। এই দেশে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস।’
গত ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমান লন্ডন থেকে সরাসরি বাংলাদেশ বিমানের নিয়মিত একটি ফ্লাইটে সিলেটে যাত্রাবিরতী করে ঢাকায় অবতরণ করেন। এদিন ভোর থেকে রাজধানী ঢাকা লাখ লাখ মানুষের পদচারণায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের প্রিয় নেতার অপেক্ষায়। তিনি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর খালি পায়ে হেঁটে হাত দিয়ে বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করে নীরবে বসেছিলেন। এ সময় আবেগঘন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই মাটিতেই ৬০ বছর আগে তাঁর জন্ম ও বেড়ে উঠা। কিন্তু মামলা ও রাজনৈতিক বেড়াজালে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন করে তারেক রহমানকে দেশ ছ্ড়াতে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে আপসহীন নেত্রী তাঁর মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগ শেষে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এখন ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধিন রয়েছেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে আয়োজিত ঐতিহাসিক এই গণসংবর্ধনা বাংলাদেশে নজিরবিহীন এক ঘটনা। আন্তর্জাতিক মহল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। বিশেষ করে ভারতের প্রভাবশালী মিডিয়া ‘দি হিন্দু’, এনডিটিভি, আনন্দবাজার পত্রিকা তারেক রহমানকে মার্টিন লুথার কিং-এর বিখ্যাত বক্তব্য ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ এর মতো ‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান’ বলে উল্লেখ করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ‘দি হিন্দু’ তারেক রহমানের ভাষণের প্রশংসা করে তাদের অন লাইনে লিড নিউজ প্রকাশ করেছে। ভারতের মিডিয়া তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করেছে যা আগে কোনদিন হয়নি।
মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সব ধর্ম ও শ্রেণি-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করার একমাত্র পথ হলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতা, কৃষক, শ্রমিক, গৃহবধূ, নারী-পুরুষ, মাদ্রাসার ছাত্রসহ দলমত ও শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষ ৫ আগস্ট দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিল’।
মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রতিক আন্দোলনের শহীদদের কথা স্মরণ করে তারেক রহমান বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের শহীদরা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এরকম একটি বাংলাদেশ গঠনের জন্য।’ তিনি অভিযোগ করেন, ১৫ বছরের স্বৈরাচারের আমলে হাজারো মানুষ গুম-খুনের শিকার হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়, নিরীহ মানুষও প্রতিবাদ করতে গিয়ে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে, জীবন দিয়েছেন। ২০২৪ সালে আমরা দেখেছি তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা কীভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য।’
সম্প্রতি শহীদ শরিফ ওসমান হাদির প্রসঙ্গ টেনে তারেক রহমান বলেন, ‘কয়েক দিন আগে এই বাংলাদেশের ২৪-এর আন্দোলনের সাহসী প্রজন্মের সাহসী সদস্য ওসমান হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। ওসমান হাদি শহীদ হয়েছেন। ওসমান হাদি চেয়েছিল এই দেশের মানুষের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। এই দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। এই দেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার ফিরে পাক।’
সব শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২৪-এর আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন ওসমান হাদিসহ, ৭১-এ যারা শহীদ হয়েছেন, বিগত স্বৈরাচারের সময় বিভিন্নভাবে খুন-গুমের শিকার হয়েছেন। এই মানুষগুলোর রক্তের ঋণ শোধ করতে আসুন আমরা প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। যেখানে আমরা সকলে মিলে কাজ করবো। যেখানে আমরা সকলে মিলে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।’ তারেক রহমান বলেন, ‘আধিপত্যবাদী শক্তির ভক্তচরেরা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রে এখন লিপ্ত রয়েছে। আমাদের ধৈর্যশীল হতে হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে।’
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারাই আগামী দিনে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন, দেশকে গড়ে তুলবেন। এই দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের সদস্যদের আজ গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে এই দেশকে আমরা সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি। শক্ত গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর গড়ে তুলতে পারি।’
এসময় মঞ্চে উপস্থিত নেতাদের কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘আমার সঙ্গে আজ মঞ্চে বহু জাতীয় নেতৃবৃন্দ বসে আছেন। আসুন আমরা দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে দোয়া করে আল্লাহর রহমত চাই। যে জাতীয় নেতৃবৃন্দ মঞ্চে আছেন, বাইরে আছেন, আমরা সকলে মিলে নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। আমাদের যে কোনো মূল্যে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। যে কোনো উস্কানির মুখে ধীর-শান্ত থাকতে হবে। আমরা দেশের শান্তি চাই, আমরা দেশের শান্তি চাই, আমরা দেশের শান্তি চাই।’
‘আসুন আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি, ইনশাআল্লাহ আগামী দিনে দেশের দায়িত্বে যারা আসবে, আমরা সকলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে ন্যায়পরায়ণতা সেই ন্যায়পরায়ণতার আলোকে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো’।
তাঁর মা খালেদা জিয়া সম্পর্কে তারেক রহমান বলেন, ‘এই একটি মানুষ, যে মানুষটি এই দেশের মাটি, এই দেশের মানুষকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসেছেন। তার সাথে কী হয়েছে আপনারা প্রত্যেকে সে সম্পর্কে অবগত আছেন। সন্তান হিসেবে আপনাদের কাছে চাইবো, আজ আল্লাহর দরবারে আপনারা দোয়া করবেন যাতে আল্লাহ উনাকে তৌফিক দেন, উনি যাতে সুস্থ হতে পারেন।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা যে ধর্মেরই মানুষ হই, যে শ্রেণিরই মানুষ হই, যে রাজনৈতিক দলের সদস্যই হই, অথবা একজন নির্দলীয় ব্যক্তি হই- আমাদের নিশ্চিত করতে হবে- যে কোনো মূল্যে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে। যে কোনো মূল্যে যে কোনো বিশৃঙ্খলা পরিত্যাগ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে মানুষ যাতে নিরাপদ থাকতে পারে। এই হোক আমাদের আজকের চাওয়া।’
তারেক রহমান ঢাকায় ফেরার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে ধন্যবাদ জানান তাঁর এবং পরিবারের জন্য সুশৃঙ্খল নিরাপত্তার আয়োজন করার জন্য। বিমানবন্দর থেকে শতশত সেনা সদস্য তাঁবে বহনকারী বাসটিকে ঘিরে হেঁটে রাজপথ পাড়ি দিয়েছেন। বিজিবি, পুলিশ, আনসারসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছিলেন। রাজধানী ঢাকা ছিল তিনস্তরের নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা। সংবর্ধনা শেষে তারেক রহমান হাসপাতালে তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফেরেন বলে জানা যায়।
