শনিবার   ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ২১ ১৪৩২   ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

অসুস্থ খালেদা জিয়ার গন্তব্য লন্ডনে

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:২৭ এএম, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ শনিবার



 
 

অসুস্থতায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। দেশী-বিদেশী চিকিৎসক দলের চেষ্টায় তাঁর অবস্থার তেমন কোনও উন্নতি হয়নি। মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেবার অনুমতি দিলে তোড়জোড় শুরু হয়। কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি কারিগরি ত্রুটির কারণে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়েছে। এই রিপোর্ট যখন ‘আজকাল’ পাঠকগণ পড়বেন; তখন খালেদা জিয়াকে বহনকারী বিমানটি লন্ডনের পথে আকাশে থাকার কথা। লন্ডনে তার পুত্র তারেক রহমান মাকে বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। এর আগে তারেক রহমান মায়ের জন্যে জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল পাঠিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার সংকটজনক অবস্থার মধ্যেও তার ছেলে তারেক রহমান পাশে নেই কেন- এটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। তারেক রহমান আসলে আবেগের চেয়ে দায়িত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে এলে হাজার হাজার মানুষ বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ছুটে এসে তারেক রহমানকে শুভেচ্ছা জানাতো। সকল দৃষ্টি তখন তারেকের দিকে পড়লে তিনি চিকিৎসা সহায়তার প্রতি মনযোগ দিতে পারতেন না। তাই আবেগকে সংবরণ করে তিনি নিজেকে দেশে আসা থেকে বিরত থেকে বিদেশী চিকিৎসকদের পাঠানোর প্রতি মনযোগ দিলেন। লন্ডনে হাসপাতাল ঠিক করার কাজও তিনি নিজেই করেছেন।
খালেদা জিয়া গত ২৩ নভেম্বর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। তার অবস্থার ক্রমেই অবণতি ঘটে। তখন থেকে গোটা দেশে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ছেয়ে যায়। খালেদা জিয়াকে সবাই আপোষহীন নেত্রী হিসাবে শ্রদ্ধা করেন। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি কখনই আপোষ করেননি। তিনি তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কোনও অশালীনতা, অসৌজন্যতাকে ঠাঁই দেননি। ৮০ বছর বয়েসী এই নেত্রী বর্তমানে দেশে অভিবাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তবে তার জীবনে অনেক প্রাপ্তি ও ত্যাগ রয়েছে। তিনি তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকিত করেন। আবার জীবনে অনেক বছর কারাগারে কেটেছে। এসবের পরও তিনি ধৈয ধারণ করেছেন।
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা দারুনভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তিনি নানাবিধ রোগে আক্রান্ত। আথ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনি ডায়লাসিস, হার্টে সমস্যাসহ নানা সমস্যায় ভুগছেন। তবে তিনি ফুসফুসে আক্রান্তের কারণে হাসপাতালে ভতি হয়েছেন। মেডিকেল টীম খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দিলে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। তারেক রহমান কেন বাংলাদেশে আসছেন না এই নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন একটি ফেসবুক পোষ্ট দেখে সবাই চমকে উঠেন। ফেসবুকে তারেক রহমান অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, তার দেশে ফেরাটা তার একক ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। তারেক রহমান না এলেও তার স্ত্রী জোবায়দা রহমান লন্ডন থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে বিমানে ওঠেন। খালেদা জিয়াকে নিয়ে তবে ফিরছেন।
তারেক রহমানের দেশে আসতে না পারায় রহস্যের জন্ম দিয়েছে। সংকটাপন্ন মায়ের সঙ্গে প্রায় ৭ মাস পর ছেলের দেখা হচ্ছে। এদিকে খালেদা জিয়ার আশু রোগমুক্তি কামনা করে আজ শুক্রবার দেশের সব মসজিদে বাদ জুমা বিশেষ দোয়া এবং সব মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জায় প্রার্থনার আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে এভারকেয়ার হাসপাতালের বাইরে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে মেডিকেল বোর্ডের সদস্য এবং খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেছেন, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার আলোকে লন্ডন নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি সবকিছু ঠিক থাকে কাতার রয়্যাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে তাকে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পরে অথবা আজ শুক্রবার সকালের ভেতরে লন্ডনে একটি নির্ধারিত হসপিটালে নিয়ে যাবার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা যায়।
তিনি বলেন, যাওয়ার সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসাবে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক এবং বাইরের দুজন চিকিৎসক খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকবেন। যাতে যাত্রাপথে কোনো ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে সুস্থভাবে বিমানে চিকিৎসা দেওয়া যায়। সেই লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে দেশের বাইরে নিয়ে যাব। এদিন বেলা তিনটার পরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যেই কাতারের আমিরের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় পৌঁছাবার কথা। শুক্রবার ভোরের মধ্যে খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স লন্ডন যাত্রা করবে বলে জানানো হয়। ১৩ দিন ধরে খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সর্বশেষ তাঁর শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দেশের সর্বস্তরের মানুষ দিন কাটাচ্ছেন।
এভারকেয়ার হাসপাতালে অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ডের অধীন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে। সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, সেটা কিছুটা উন্নতির দিকে। তবে হৃদযন্ত্রে জটিলতা রয়েছে। বাকি সমস্যাগুলো অনেকটাই অপরিবর্তিত। বুধবার রাতে চারজন চীনা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় আসেন। রাতেই তারা খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডে যোগ দেন। এর আগে দুপুরে যুক্তরাজ্য থেকে ঢাকায় আসেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রিচার্ড বেলে। তিনি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি এভারকেয়ার হাসপাতালে যান। চিকিৎসকরা বুধবারই খালেদা জিয়ার সর্বশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদনগুলো দেখেন।
এর আগে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত জানুয়ারি মাসে লন্ডনে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সেখানে প্রথমে লন্ডন ক্লিনিকে, পরে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় থেকে তিনি চিকিৎসা নেন। প্রায় চার মাস পর গত ৬ মে তিনি দেশে ফেরেন।
গত ২৩ নভেম্বর রাতে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরীক্ষায় ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ায় তাকে ভর্তি করা হয়। গত রোববার ভোরের দিকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে এসডিইউ থেকে সিসিইউতে নেওয়া হয়।
এদিকে বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন ১৫ জন। তারা হলেন-খালেদা জিয়ার দুই পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমান, চিকিৎসক এজেডএম জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোহাম্মদ এনামুল হক চৌধুরী, ডা. ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকি, ডা. মো. শাহাবুদ্দিন তালুকদার, ডা. নূরউদ্দিন আহমদ, ডা. মো. জাফর ইকবাল, চিকিৎসক মোহাম্মদ আল মামুন, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) হাসান শাহরিয়ার ইকবাল, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের সৈয়দ সামিন মাহফুজ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সহকারী মো. আবদুল হাই মল্লিক, সহকারী ব্যক্তিগত সচিব মো. মাসুদুর রহমান, গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম ও গৃহকর্মী রূপা শিকদার।
এদিকে চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়া কবে দেশে ফিরতে পারবেন-এ বিষয়ে চিকিৎসকরা কোনো তথ্য জানাতে পারেননি। এ কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে এক ধরনের দুশ্চিন্তা ভর করছে। দলীয়ভাবে তার রোগমুক্তি কামনায় সারা দেশে দোয়া করছেন নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। ৮০ বছর বয়সি খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যাসহ নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন তিনি। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সাজা ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম স্থগিত) সরকার। গুলশানে বাসায় থাকলেও বেশির ভাগ সময়ই তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। উন্নত চিকিৎসায় তাকে বিদেশে নেওয়ার জন্য অন্তত সাতবার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হলেও তাতে সাড়া দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে এভারকেয়ার হাসপাতালে তার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়।
এছাড়া সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর হার্টে তিনটি ব্লক ছিল। একটিতে রিং পরানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে খালেদা জিয়ার রক্তনালিতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শের বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করছি না। মেডিকেল বোর্ড বুধবার তিনবার ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছে। ফিজিক্যালি দেখেছেন যুক্তরাজ্য ও চীনের চিকিৎসকরা। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া আল্লাহর অশেষ রহমতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এবারও ইনশাআল্লাহ তিনি আবারও আমাদের মাঝে ফেরত আসবেন।
রোগমুক্তি কামনায় আজ সারা দেশে দোয়া ও প্রার্থনা : সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় আজ শুক্রবার সারা দেশে দোয়া ও প্রার্থনা আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সংস্থা-১ শাখা থেকে পত্র জারি করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত পত্রে বলা হয়, খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সরকার তার আশু রোগমুক্তি কামনা করে শুক্রবার দেশের সব মসজিদে বাদ জুমা বিশেষ দোয়া এবং সব মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জায় প্রার্থনা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।