বৃহস্পতিবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩২   ০৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

স্বর্ণালংকার লুকাতেও সিদ্ধহস্ত শেখ হাসিনা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৩৪ এএম, ২৭ নভেম্বর ২০২৫ বৃহস্পতিবার

শুধু গুম-খুন নয়, অবৈধ সম্পদ লুকাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনি হলফনামা ও আয়কর রিটার্নে উল্লি­খিত সম্পদের সঙ্গে বাস্তবে রয়েছে ব্যাপক গরমিল। আয়কর রিটার্নে ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকার স্বর্ণালংকারের ঘোষণা দিলেও তার ব্যাংক লকারে পাওয়া গেছে বর্তমান বাজারমূল্যে ১৭ কোটি টাকার স্বর্ণালংকার। জব্দ করা স্বর্ণের পরিমাণ ৯ কেজি ৭শ গ্রাম। হলফনামায় কৃষিজমির পরিমাণ ৫ দশমিক ২ একর উল্লে­খ করলেও বাস্তবে ২৯ একর কৃষিজমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া নামে-বেনামে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তার পরিবারের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।

 

গত বছরের ৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। এ দুটি সংস্থার তথ্য ও নির্বাচনি হলফনামা পর্যালোচনা করে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

 

আয়কর আইন অনুযায়ী সব করদাতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। বিবরণীর বাইরে সম্পদ থাকলে তা প্রচলিত আইনে অবৈধ সম্পদ হিসাবে গণ্য করা হয়। আয়কর রিটার্নে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার থাকার কথা উল্লে­খ করেন।

 

অপরদিকে শেখ রেহানা উল্লে­খ করেন এক লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার। কিন্তু এই দুজনই আয়কর নথিতে ব্যাংকে লকার থাকার কথা বেমালুম চেপে যান। যদিও আয়কর আইনে লকারের তথ্য উলে­খ করা বাধ্যতামূলক।

 

অথচ মঙ্গলবার অগ্রণী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নামে থাকা ৩টি লকার খুলে ৮৩২ ভরি স্বর্ণের খোঁজ পায় দুদক ও সিআইসি। স্বর্ণালংকারের পাশাপাশি স্বর্ণের নৌকা ও হরিণ পাওয়া গেছে। পূবালী ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখায় শেখ হাসিনার একক নামে থাকা লকারটিতে একটি খালি পাটের ব্যাগ পাওয়া গেছে। অগ্রণী ব্যাংক প্রিন্সিপাল শাখায় শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের যৌথ নামে থাকা লকারটিতে আনুমানিক ৪ হাজার ৯২৩ গ্রাম স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়। একই শাখায় শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা সিদ্দিকের নামে থাকা যৌথ লকারে আনুমানিক ৪ হাজার ৭৮৩ গ্রাম স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়। লকারে স্বর্ণালংকারের সঙ্গে একটি চিরকুট পাওয়া গেছে। সেখানে শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের অন্য সদস্য শেখ রেহানা সিদ্দিক, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, সজীব ওয়াজেদ জয় ও ববির নাম লেখা আছে।

 

আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত করদাতারা সম্পদ বিবরণীতে স্বর্ণের পরিমাণ ভরিতে উল্লে­খ করেন এবং মূল্য অজানা হিসাবে দেখান। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী রিটার্নে স্বর্ণালংকারের মূল্য উল্লে­খ করলেও পরিমাণের তথ্য গোপন করেন। রিটার্নে উল্লি­খিত মূল্যে তিনি কত ভরি স্বর্ণালংকার অর্জন করেছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা নিরূপণ করা কিছুটা জটিল হবে। কেননা প্রতিবছরই স্বর্ণের দাম বাড়ছে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী সাড়ে ১৩ লাখ টাকায় ৬ ভরি স্বর্ণ পাওয়া যাবে। এই স্বর্ণই ১০ বছর আগে কিনলে হয়তো ১৬ ভরি কেনা যেত। তাই আয়কর বিভাগের চোখ ফাঁকি দিতে তিনি পরিমাণ উল্লে­খ না করে মূল্য লিখে চাতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন।

 

সিআইসির কর কর্মকর্তারা বলছেন, শেখ হাসিনা পরিবারের কর ফাঁকি অনুসন্ধানে দেশের সব ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ও ডাক বিভাগের কাছে ব্যাংক হিসাব বিবরণী, সঞ্চয়পত্র, বন্ড, লকার সার্ভিস ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চাওয়া হয়। সব ব্যাংক থেকে তথ্য পাওয়া গেলেও পূবালী ব্যাংক লকারের তথ্য দেয়নি। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে লকার জব্দ করা হয়। কর কর্মকর্তাদের ধারণা, পূবালী ব্যাংকের লকারে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র থাকতে পারে। লকার খোলার পর সেখানে পাটের ব্যাগ চেইন খোলা অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সরিয়ে ফেলা হতে পারে। এই ব্যাগ ঘিরে এখন রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। এমনকি এই লকার ৫ আগস্টের পর কেউ খুলেছেন কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন সামনে আসছে।

 

এদিকে বুধবার দুপুরে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নামে ব্যাংকের লকারে থাকা স্বর্ণালংকারের বিষয়ে দুদকের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে ব্রিফ করা হয়। এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, স্বর্ণগুলো জ্ঞাতআয়বহির্ভূত কিনা- সেটি যাচাই-বাছাই করে তদন্তকারী কর্মকর্তা দেখবেন। তদন্ত করার আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।

 

যৌথ লকারে থাকা স্বর্ণালংকারের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত স্বর্ণ কতটুকু- এমন প্রশ্নে দুদক মহাপরিচালক বলেন, প্রতিটা নামে আলাদা আলাদা করে স্বর্ণ রাখা আছে। কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই করে দেখবেন, সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিজ নামে কতটুকু স্বর্ণ রয়েছে।

 

আক্তার হোসেন বলেন, ২০০৭ সালে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে শেখ হাসিনা পূবালী ব্যাংকে তার নিজ নামে একটি লকার ও অগ্রণী ব্যাংকে ২টি লকার থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মঙ্গলবার একজন মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ, একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, দুুদকের অনুসন্ধানের তদারককারী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের বুলিয়ন শাখার একজন স্বর্ণ বিশেষজ্ঞ, এনবিআরের সিআইসির দুজন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যাংক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে লকার তিনটি খোলা হয়।

 

হলফনামায় যা আছে : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কৃষি খাত থেকে শেখ হাসিনা আয় দেখিয়েছেন ৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত আছে ২৫ লাখ টাকা, চাকরি থেকে বার্ষিক আয় ১৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা, ব্যাংক সুদ ও এফডিআর থেকে প্রাপ্তি ৩২ লাখ ২৫ হাজার টাকা, রয়্যালেটি হিসাবে ২৩ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ ২৮ হাজার ৫৩০ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৩৮ লাখ ৯৮ হাজার ৬০৭ টাকা, সঞ্চয়পত্র ২৫ লাখ টাকা, এফডিআর ৫৫ লাখ টাকা, ৩টি মোটরগাড়ি, ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা স্বর্ণালংকার এবং ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা আসবাবপত্র দেখানো হয়েছে। স্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে- ১৫ বিঘা কৃষি জমি, ঢাকার পূর্বাচলে ২৭নং সেক্টরের ২০৩নং রোডের ৯নং প্লট। এই প্লটের আনুমানিক মূল্য দেখানো হয়েছে ৩৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এছাড়া ৫ লাখ টাকা মূল্যের ঢাকায় ৩ তলা ভবনসহ ৬ দশমিক ১০ শতাংশ জমি দেখানো হয়েছে।

 

শতকোটি টাকার সম্পদ : তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীতে হাসিনা পরিবারের নামে শতকোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর এসব সম্পদ থেকে প্রতিনিধির মাধ্যমে নিয়মিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গুলশান নিকেতনের ২নং রোডের ৭২ নম্বর বাড়ির মালিক শেখ রেহানা। আয়কর নথি অনুযায়ী এই বাড়ির মালিক তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। এই বাসার ভাড়া তোলেন ডেভেলপার কোম্পানির কর্মীরা। কাগজে-কলমে বারিধারার কে ব্লকের ১০ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর বাড়িটির মালিক সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তবে প্রকৃতপক্ষে এই বাড়ির মালিক শেখ পরিবার। আয়কর রিটার্নের তথ্য অনুযায়ী বাড়িটির মালিক হাসিনাকন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। যার দাম দেখানো হয়েছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। অপরদিকে গুলশান-১ এর ৭ নম্বর বাড়িটি নিজের বলে দেখিয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এছাড়া সেগুনবাগিচায় শেখ রেহানার একটি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে।

 

সোমবার হবিগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমিতে দুদকের জেলা সমন্বিত কার্যালয় আয়োজিত এক গণশুনানিতে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন বলেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তার সম্পত্তির একটা বিরাট রকম গোঁজামিল দিয়ে ২০০৮ সালে নির্বাচন করেছেন। ওই নির্বাচনি হলফনামায় শেখ হাসিনা কৃষি সম্পত্তি ৫ দশমিক ২ একর দেখিয়েছেন। অথচ দুদকের অনুসন্ধানে ২৯ একরের সন্ধান পাওয়া যায়। সে সময় দুদক বিষয়টি নিয়ে কাজ করলেও মনোনয়ন বাতিলে পদক্ষেপ নিতে পারেনি।