সোমবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩২   ০৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

বিহারে মায়েদের বুকের দুধে ইউরেনিয়াম, গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:২১ এএম, ২৪ নভেম্বর ২০২৫ সোমবার

ভারতের বিহারের বিভিন্ন জেলায় মায়েদের বুকের দুধে উদ্বেগজনক মাত্রায় ইউরেনিয়াম (ইউ-২৩৮) পাওয়া গেছে যা শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।

 

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের মতে, বুকের দুধের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম মানবদেহে প্রবেশ করলে শিশুদের জন্য উল্লেখযোগ্য অ–কার্সিনোজেনিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

 

এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গবেষণা প্রতিবেদনের সহ–লেখক ড. অশোক শর্মা বলেন, ‘গবেষণায় ৪০ জন দুগ্ধদানকারী মায়ের বুকের দুধ পরীক্ষা করা হয় এবং সব নমুনায়ই ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে। যদিও ৭০ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অ–কার্সিনোজেনিক স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত হয়েছে, সামগ্রিকভাবে ইউরেনিয়ামের মাত্রা অনুমোদিত সীমার নিচে ছিল এবং মায়েদের ও শিশুদের ওপর প্রকৃত স্বাস্থ্যঝুঁকি খুব কম বলেই আশা করা হচ্ছে।’

 

তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি গড় মাত্রা পাওয়া গেছে রাজ্যের খাগড়িয়া জেলায় এবং সর্বোচ্চ একক মাত্রা পাওয়া গেছে কাটিহার জেলায়। ইউরেনিয়াম শিশুর স্নায়ুবিক বিকাশ ব্যাহত বা আইকিউ কমিয়ে দিতে পারে—তবুও বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা উচিত নয়, কারণ এটি শিশুদের জন্য সবচেয়ে উপকারী পুষ্টির উৎস, যদি না চিকিৎসাগত কোনো কারণ থাকে।’

 

তিনি আরও জানান, ‘গবেষণায় দেখা গেছে ৭০ শতাংশ শিশুর এইচকিউ মান ১-এর বেশি, যা বুকের দুধের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম গ্রহণের ফলে সম্ভাব্য অ–কার্সিনোজেনিক ঝুঁকির নির্দেশক। দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শে ইউরেনিয়াম শিশুদের— কিডনি বিকাশ, স্নায়ুবিক বিকাশ এবং মানসিক ও জ্ঞানীয় সক্ষমতা (কম আইকিউ, নিউরোডেভেলপমেন্টাল বিলম্বসহ) প্রভাবিত করতে পারে।’

 

ড. শর্মা জানান, ‘বুকের দুধে ০–৫.২৫ মাইক্রোগ্রাম/লিটার ইউরেনিয়াম পাওয়া গেলেও গবেষণার সামগ্রিক সিদ্ধান্ত হলো শিশুদের ওপর প্রকৃত স্বাস্থ্যঝুঁকি খুবই কম। কারণ মায়েদের দেহে প্রবেশ করা অধিকাংশ ইউরেনিয়াম প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়, বুকের দুধে তা বেশি মাত্রায় জমা হয় না। তাই বিশেষ চিকিৎসাগত কারণ না হলে বুকের দুধ খাওয়ানোই সবচেয়ে উত্তম।’

 

তিনি আরও জানান, ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে একই ধরনের গবেষণা করা হবে। ‘আমরা অন্যান্য রাজ্যেও ভারী ধাতুর উপস্থিতি ও সেগুলোর মানবস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা করছি—এটি এখন সময়ের দাবি,’ বলেন তিনি।

 

গবেষণায় বিহারের বিভিন্ন জেলার ৪০ জন দুগ্ধদানকারী নারীর বুকের দুধে ইউরেনিয়ামের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে। সব নমুনাতেই ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে, যার মধ্যে কাটিহার জেলার নমুনায় সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে।

 

স্বাস্থ্যঝুঁকি মূল্যায়নে দেখা যায় যে শিশুরা ইউরেনিয়ামের প্রভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ তাদের দেহে এই ধাতু অপসারণের ক্ষমতা সীমিত।

 

গবেষণার হিসাব অনুযায়ী, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৭০ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে অ–কার্সিনোজেনিক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে।

 

ইউরেনিয়াম একটি প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় মৌল, যা সাধারণত গ্রানাইটসহ বিভিন্ন শিলায় পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বা মানবীয় কর্মকাণ্ড—যেমন খনন, কয়লা পোড়ানো, পারমাণবিক শিল্পের নির্গমন, কিংবা ফসফেট সার ব্যবহারের মাধ্যমে—এটি ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে যেতে পারে।

 

বুকের দুধে কীটনাশক ও অন্যান্য পরিবেশ দূষকের উপস্থিতি শনাক্ত করতে আগামীর গবেষণার বিষয়ে ড. শর্মা বলেন, ‘এই গবেষণাপত্রে ভবিষ্যৎ গবেষণার দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে এবং তাতে কীটনাশকও অন্তর্ভুক্ত। আগের গবেষণায় আমরা বুকের দুধে আর্সেনিক, সিসা এবং পারদের উপস্থিতি পেয়েছিলাম। শিশুদের ঝুঁকি বোঝার জন্য বুকের দুধে বিষাক্ত দূষক—যেমন কীটনাশক—পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা আমরা জোরালোভাবে উল্লেখ করেছি।’

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানির জন্য ইউরেনিয়ামের অস্থায়ী গ্রহণযোগ্য সীমা প্রতি লিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণ করেছে, আর জার্মানির মতো কিছু দেশ আরও কঠোরভাবে ১০ মাইক্রোগ্রাম/লিটার সীমা অনুসরণ করে।

 

ভারতে ইতিমধ্যে ১৮ রাজ্যের ১৫১টি জেলায় ইউরেনিয়াম দূষণ শনাক্ত হয়েছে বলে জানা যায়, যার মধ্যে বিহারের ১.৭ শতাংশ ভূগর্ভস্থ জলস্রোত দূষিত।

 

বিশ্বব্যাপী কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ, চীন, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, পাকিস্তান এবং নিম্ন মেকং ডেল্টা অঞ্চলে উচ্চ মাত্রার ইউরেনিয়াম দূষণ লক্ষ্য করা গেছে।

 

যদিও বিশ্বজুড়ে বহু গবেষণায় ভূগর্ভস্থ জলে ইউরেনিয়ামের উচ্চমাত্রা পাওয়া গেছে, তথাপি আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্পষ্ট ক্লিনিক্যাল উপসর্গ সবসময় দেখা যায়নি।