শেখ হাসিনার মৃত্যুদন্ডে চ্যালেঞ্জে আ.লীগ
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ১২:০২ এএম, ২২ নভেম্বর ২০২৫ শনিবার
নাটকের শেষ দৃশ্য এখনও বাকি। চব্বিশের জুলাইয়ে এক অভাবনীয় অভ্যূত্থানে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিলে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটতে থাকে। ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন জয়ী হবার পর বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে জুলাই সনদে তৈরী হয় তার রুপরেখা। বাংলাদেশের ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল’ (আইসিটি) দেয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায়। তারপরেই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের আমন্ত্রণে দিল্লি যান বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। এই ধারাবাহিকতায় নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অর্ন্তবর্তি সরকারের ‘এক্সিট প্ল্যান’ এখনও অস্পষ্ট। অনেক প্রশ্নের জবাব না মেলায় ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট মেঘ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। অনিশ্চয়তার একটা দোলাচল চারপাশ ঘিরে আছে। অনিশ্চয়তা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়েও। শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার পর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির কান্ডারী কে হবেন এই প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে। উত্তরসূরি নির্বাচনে দলটি বরাবরই উদাসীন থেকেছে।
আইসিটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছে। ওই সময়ের আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে রাজসাক্ষী হয়েছেন। এ কারণে তার পাঁচ বছরের কারাদন্ড হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এই বিচার হয়েছে বলে অর্ন্তবর্তি সরকার ও তার সমর্থক দলগুলো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বিশেষ করে জুলাই শহীদদের পরিবার এই বিচারের রায় অবিলম্বে কার্যকর করার দাবি জানিয়েছে। তবে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল ভারতে অবস্থান করছেন। মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হলেও তা কার্যকর করা তাই সম্ভব হচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে বিচার ও রায় অনুপস্থিতিতে হয়েছে। তাদেরকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এক মাসের মধ্যে আপীল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবুও তারা হাজির না হলে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশও রায়ে দেওয়া হয়েছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে সমর্থন করলেও তাদেরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বিরোধিতা করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। মৃত্যুদন্ডের বিধান বাংলাদেশের আইনে থাকলেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নিয়মে তা অগ্রহনযোগ্য। ফলে এই রায়কে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সমালোচনা করেছে। অপরদিকে, মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের ভারত ছাড়াও আরও অনেক দেশ আশ্রয় দিতে আগ্রহী হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা নিজে এই বিচারকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন,এটি একটি ক্যাঙ্গারু কোর্ট। অর্থাৎ এই কোর্টকে কিছুতেই ন্যায়বিচারের উপযুক্ত নয় বলে তিনি মনে করেন। ক্যাঙ্গারু যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এই ট্রাইব্যুনালও একইভাবে চলে বলে তার মন্তব্য। আইসিটি মূলত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত হয়েছিলো। মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেক জামায়াতে ইসলামীর নেতাকে এই ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে তা কার্যকর করা হয়েছে। সেই আইনের কিছু সংশোধনী এনে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার করা হচ্ছে। আইসিটিতে জামায়াতের আইনজীবিকে প্রসিকিউশনে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র শেখ হাসিনার জন্য যে আইনজীবী নিযুক্ত করেছে তার ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। সার্বিকভাবে এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তার দল আওয়ামী লীগ রায়ের সময়ে লকডাউন এবং শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেছে। শেখ হাসিনা মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হওয়ায় তার দল আওয়ামী লীগও বেশ চাপে পড়েছে। দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিতা দলের সমর্থকদের মধ্যে দানা বেঁধেছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা এই প্রশ্নে এখনও দ্বিধান্বিত জনমত। দিল্লির উদ্দেশ্যে খলিলুর রহমানের ঢাকা ত্যাগের আগেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। যদিও ভারত আগে থেকেই অর্ন্তভুক্তিমূলক নির্বাচন চেয়েছে। নিরাপত্তা বিষয়ক কলম্বো কনক্লেভ নামের একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে অংশ নিতে খলিলুর রহমান ভারত সফর করেন। স্বাগতিক দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে অজিত দোভাল এই আমন্ত্রণ জানান। দিল্লিতে দোভালের সঙ্গে খলিলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। খলিলুর রহমান এ সময় অজিত দোভালকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানান। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে কোনও পক্ষই সুস্পষ্ট কোনও কিছু বলেনি। ধারণা করা যায়, শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ এবং নির্বাচনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভারতের নাকগলানো নতুন নয়। ওয়ান ইলেভেনের সময় এক্সিট প্লেন নিয়ে আলোচনা করতে ওই সময়ের সেনাবাহিনী প্রধান মইন উ আহমেদ ভারত সফর করেন। তিনি সেখানে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সহায়তা কামনা করেন। প্রণববাবু শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করে ইনক্লুসিভ নির্বাচন দিতে বলেন। এই বিষয়টি প্রণব মুখার্জির বইয়ে উল্লেখ আছে। তারপরও এমন হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফরে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তখন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে বৈঠকের পর এরশাদ রাজনৈতিক আলাপ ফাঁস করেন। এবারের নির্বাচনের পূর্বে ভারতের তরফে সরাসরি বড় কোনও প্রস্তাব দেওয়ার খবর জানা যায়নি। তবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, বাংলাদেশে ভারত অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য, অর্ন্তভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে। অর্ন্তভুক্তিমূলক নির্বাচনের ব্যাখ্যা না দিলেও একথা সহজেই অনুমেয় যে, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেবার সুযোগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আওয়ামী লীগ এবং তার মহাজোটভুক্ত জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। এই দলগুলোর কমপক্ষে ৩০ শতাংশ ভোট রয়েছে। তাদের নির্বাচনের বাইরে রাখলে সমর্থকেরা পছন্দের প্রার্থী পাবেন না।
