সোমবার   ১০ নভেম্বর ২০২৫   কার্তিক ২৫ ১৪৩২   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

কেন বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যু

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ১২:৫৪ এএম, ১০ নভেম্বর ২০২৫ সোমবার

► শনাক্তে বিলম্ব, দেরিতে হাসপাতালে আসা এবং ফ্লুইড ব্যবস্থায় অসংগতিকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা ► চলতি বছরে মারা গেছেন ৩১৩ জন

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার সাহেবপাড়ার আবদুল আওয়াল (৪১) কয়েক দিন ধরে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ অক্টোবর মারা যান আওয়াল। পরদিন তার লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে মা রেহেলা আক্তার (৬৯) ছেলের মুখ দেখে শোকে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

 

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩১৩ জন, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৮ হাজার ৫৪৩ জন। নভেম্বরের ৯ দিনেই মারা গেছেন ৩৫ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৮১ জন।

 

এই বছরে মৃত রোগীদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ২৬-৩০ বছর বয়সি ৪১ জন তরুণ। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৯৫ জন, মারা গেছেন ছয়জন। মহাখালী ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে দুজন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন ডেঙ্গুরোগী মারা গেছেন। ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু নিয়ে তৈরি হচ্ছে শঙ্কা। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন

 

মো. মঈনুল আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখন অধিকাংশ রোগী ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে মারা যাচ্ছে। অধিকাংশ রোগী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন। মারা যাওয়া রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় ২৪ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন। তাই জ্বর এলে এনএস১ টেস্ট করে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে এই টেস্ট করানো হচ্ছে। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে, সমস্যা দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’

 

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণ রয়েছে। এগুলো হলো; ডেঙ্গু শনাক্তে বিলম্ব, হাসপাতালে ভর্তি হতে দেরি এবং ফ্লুইড ব্যবস্থাপনায় ভুল। এই তিন কারণেই মৃত্যুহার বাড়ছে। অনেক রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বরকে ‘সাধারণ জ্বর’ ভেবে সময় নষ্ট করেন। ফলে অনেক সময় প্লাজমা লিকেজ, মাল্টি অরগ্যান ড্যামেজসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। এরকম সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছালে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, এখন সারা বছরেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অক্টোবরে সর্বোচ্চ আক্রান্ত এবং মৃত্যু। নভেম্বরেও মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী। এবার ডেঙ্গুর আরেকটা প্রবণতা ছিল- তা হলো, গ্রামাঞ্চলগুলোতে, ছোট ছোট শহরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রবণতা বেড়েছে। এ থেকে আমাদের একটা শঙ্কার দিক তৈরি হলো যে, আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছরে হয়তো গ্রামগুলো ডেঙ্গুর প্রকোপে জর্জরিত হবে। স্বাস্থ্যসেবা, ডেঙ্গু শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা সবই রাজধানীকেন্দ্রিক। বড় বড় শহরগুলোতেও ডেঙ্গুর চিকিৎসা অত্যন্ত দুর্বল। যার ফলে ডেঙ্গুজ্বরে চিকিৎসাটা ঠিকমতো হবে না এবং মৃত্যুর শঙ্কা বাড়বে। গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু একটা বিশেষ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা যাবে।’

 

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষষা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, দরিদ্র ডেঙ্গুরোগীরা হাসপাতালে আসছেন দেরিতে। তারা ইচ্ছে করে দেরিতে আসছেন, বিষয়টা এমন নয়। কারণ তাদের ঘরের কাছে ডেঙ্গু পরীক্ষার সরকারি সুবিধা নেই। প্রাইমারি হেলথ কেয়ার থাকলে তারা রক্তচাপ চেক করাতে পারত। এখন ডেঙ্গু শকসিনড্রোমে মারা যাচ্ছে বেশি। ব্লাডপ্রেশার চেক না করার কারণে তারা প্রেশার কমা-বাড়া জানতে পারছে না।’