‘দেশে নির্বাচন না গৃহযুদ্ধ!’
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ১২:৫০ এএম, ১ নভেম্বর ২০২৫ শনিবার
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনীতিতে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের দিনক্ষণ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচন বানচাল করার জন্যে দেশী-বিদেশী চক্র সক্রিয় রয়েছে। নির্বাচন নিয়ে চলছে নানামুখি ষড়যন্ত্র। থমকে যাচ্ছে নির্বাচনী ট্রেন। ষড়যন্ত্রে সরকারের ভেতরেরও একটি শক্তি। অনেকেই বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে। গণভোট নিয়েই নির্বাচন বানচালের ফাঁদ পাতানো হয়েছে। ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে গোলক ধাঁধাঁ। বিএনপি মহাসচিব ফকরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোন হাঁ-না ভোট হবে না। তা হতে হলে জাতীয় নির্বাচনের দিনই হতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রিয়াজ বলেছেন, আগামী নির্বাচিত সংসদ একটা নির্ধারিত সময়ে এই সনদ সংসদে অনুমোদন না করলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অর্ন্তভুক্ত হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে তীব্র মতবিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি বলছে, এটা জাতির সাথে প্রতারণা। অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি গণভোট দেবার আহ্বান জানিয়েছে। দলটি ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন না করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে থাকা সক্রিয় দলগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। এক্ষত্রে, এক নম্বর অবস্থানে আছে বিএনপি। ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত জুলাই-আগস্ট অভ্যূত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণ সমাজকে নিয়ে গঠিত নতুন দল এনসিপি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচন থেকে সরে আসার ইঙ্গিতও দিচ্ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এক সঙ্গে আন্দোলন করা দলগুলো এখন পরস্পরের মুখোমুখি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত এক বছর যাবত অনেকবার বৈঠক করে শুধু অনৈক্য সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশে অভ্যূত্থান পরবর্তি সময়ে কী ধরনের সংস্কার পরিচালিত হবে তা নির্ধারণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত এক বছর যাবত একের পর এক বৈঠক করেছে। ওই সকল বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন করা হয় যাতে বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন দল সই করেছে। তবে এই সনদ বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট রুপরেখা না থাকায় এনসিপি জুলাই সনদে সই করেনি। শুধু জুলাই সনদে সই করা নিয়ে নয়; বরং নির্বাচনের মাঠেও মুখোমুখি বিএনপি-জামায়াত। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর ওপর হামলা হচ্ছে বলে দলটি অভিযোগ করছে।
বাংলাদেশে বিগত বিভিন্ন নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী খুব বেশি ভোট পায়নি। স্বাধীনতা বিরোধী এই দলটি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৮ আসনে জয়লাভের ইতিহাস আছে। কিন্তু এবার জামায়াত ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা প্রধান বিরোধী দল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। দেশের চারটি প্রধান বিদ্যাপিঠ - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির বিপুল বিজয় অর্জন করেছে। এতে করে জামায়াতের মধ্যে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে জামায়াত বিশেষ টার্গেট ভোটারের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারী ভোটারদের টার্গেট করে তাদের মধ্যে ‘তালিম’ তথা ইসলামী বয়ান নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে।
এত কিছুর পরও এখন পর্যন্ত সাধারন ধারণা হলো, বিএনপি আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করবে এবং সরকার গঠন করবে। বিএনপি’র মনোনয়ন লাভে তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি জেলায় জেলায় প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই করার জন্যে শীর্ষস্থানীয় কোনও কোনও নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছে। নেতারা একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা করার পর তাদের ঢাকায় ডেকে সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই দলটি চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণা করবে। যদিও জামায়াতে ইসলামী প্রায় সব আসনে প্রার্থীর মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। এনসিপি এখন পর্যন্ত ১৭০ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে পেরেছে। বিএনপি’র জন্য একটা বড় সংকট তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে সুস্পষ্ট দিনক্ষণ না পাওয়া। প্রথমে শোনা গিয়েছিলো যে, তারেক রহমান নভেম্বরের প্রথমার্ধে দেশে ফিরবেন। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে, তিনি নভেম্বরের ২০ তারিখ পবিত্র ওমরাহ পালনের লক্ষ্যে সৌদি আরব সফর করবেন। তারপর সেখান থেকে তিনি আবার লন্ডন ফিরে যাবেন। এখন মনে হচ্ছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তিনি দেশে ফিরবেন। কি জন্যে তার এই দেরিতে দেশে ফেরা। বিএনপি নেতারা বলছেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি দেরি করছেন। এটা একেবারেই অস্পষ্ট যে, তার নিরাপত্তার হুমকি কারা সৃষ্টি করতে পারে। এমনওতো হতে পারে যে, নির্বাচন নিয়ে খানিকটা অনিশ্চিত পরিস্থিতি দেখছেন তিনি। নির্বাচন মধ্য ফেব্রুয়ারির আগেই হবে এমন নিশ্চয়তা পেলেই তবে তারেক রহমান দেশে আসবেন বলে মনে হচ্ছে। তবে যে কারণেই হোক, তারেকের দেশে ফিরতে যত দেরি হবে ততই তিনি মাঠ হারাতে থাকবেন। কারণ নির্বাচনের আগে মাঠের পরিচর্য ছাড়া মাঠ দখলে রাখা কঠিন। কারণ প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীরা মাঠে যথেষ্ঠ পরিচর্যার সৃষ্টি করে থাকে। এবারের নির্বাচনে নানা ফ্যাক্টর থাকবে বলে মনে হচ্ছে।
এদিকে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনটি বিদেশী সংবাদ মাধ্যম --রয়টার্স, এএফপি এবং লন্ডনের ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো ভুল। তিনি হত্যার জন্যে পুলিশকে নির্দেশ দেননি। এছাড়া, তার দল আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার চেষ্টা হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে সুযোগ না দেওয়া হলে দলটির মিলিয়ন মিলিয়ন সমর্থক ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে যাবে না। শেখ হাসিনা এমন মন্তব্য এমন এক সময়ে করলেন যখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্তত একটি মামলা খুব সহসা রায় হবে। অপরদিকে, প্রধান উপদেষ্টার ভাষ্য মতে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। ফলে নির্বাচন নিয়ে আশার কথাও আছে। আছে নিরাশার কথাও। আশা-নিরাশার মধ্যে দোল খাচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে ফেরার স্বপ্ন।
