সোমবার   ১৩ অক্টোবর ২০২৫   আশ্বিন ২৭ ১৪৩২   ২০ রবিউস সানি ১৪৪৭

লীগ থেকে সরে গেল ভারত

মাসুদ করিম, মুম্বাই থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৩৯ এএম, ১১ অক্টোবর ২০২৫ শনিবার


   
 
আওয়ামী লীগই ভারতের প্রথম পছন্দ। শেখ হাসিনাই তাদের পরম বন্ধু। কিন্তু একমাত্র পছন্দ নয়। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশি দেশটি নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। ভারত দ্বিতীয় পছন্দ হিসাবে বিএনপিকেও আস্থায় নিয়েছে। এমন কি জামায়াতও যদি ক্ষমতায় যায় কিংবা প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে সেই বাস্তবতা মেনে নেবার জন্যেও মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি। ‘হর্সেস মাউথ’ থেকে এমন উচ্চারণে সবাই একটু নড়েচড়ে বসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচনের পর যে-ই শপথ নেবে তার সঙ্গেই কাজ করবে ভারত। তিনি আরও যোগ করেন, সম্পর্কটা হবে ভবিষ্যৎ মুখী। তবে মিশ্রি এও বলেন যে, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অর্ন্তভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ভারত চায়। বাংলাদেশে নির্বাচনের বৈধতার জন্যে শুধু নয়; বর্হিবিশ্বে এমন কি এই অঞ্চলের বাইরেও বৈধতা পেতে হবে।
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই শেখ হাসিনার শাসনকালকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ‘সোনালী অধ্যায়’ হিসাবে অভিহিত করেছে। সাউথ ব্লকে এখন ভিন্ন সুর। হাজার হোক প্রতিবেশি দেশ। সম্পর্কতো থাকতে হবে। বেগম খালেদা জিয়ার সময়েও সম্পর্ক ভালই ছিলো। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অর্ন্তবর্তি সরকারের প্রধান হবার আগে বিভিন্ন সময়ে ভারত সফর করেন। ওই সময়ে ভারতের পার্লামেন্টে তিনি ভাষণও দিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ ভারতে বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করেছিলো। তারপরও এখন সম্পর্কটা কেন খারাপ হয়ে গেছে এই নিয়ে গবেষণা করছে ভারতের বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যাক্তি। বাংলাদেশে সবাই একটা কারণই একবাক্যে উচ্চারণ করে আর সেটা হলো, ভারত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছে। ভারতে কারণে টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। এখনও বাংলাদেশে অনেকে মনে করেন, ভারত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রতিবেশি দেশ হিসাবে ভারতের উচিত ছিলো সকল দলের সঙ্গেই সম্পর্ক সৃষ্টি করা। সবগুলো ডিম এক ঝুড়িতে না রাখা। সেই কারণে এখনও সম্পর্ক ভাল হচ্ছে না। তবে বিক্রম মিশ্রি বিষয়টা খোলাসা করেছেন। দিল্লিতে সফররত ‘ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্টস এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ’ (ডিকাব) সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ভারতীয় সচিব বলেন, অতীত পানে চেয়ে থেকে নয়। ভারত ভবিষ্যতের দিকে চাইবে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময়কালে তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোকপাত করেন। এতে সীমান্ত হত্যা, পুশইন, পানিবন্টন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারত সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের একটা দিক হলো রাজনীতি। এই দুই দেশের সম্পর্কে উত্তাপ-উত্তেজনা যেমন আছে; তেমনি আছে বন্ধুত্বও। তবে রাজনৈতিক সম্পর্ক ভাল না হলে অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক এবং অন্য ক্ষেত্রগুলো প্রভাবিত হয়। তাই ভারত এখন স্পষ্টত অনুধাবন করেছে যে, এক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা ভুল হয়েছে। সবার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখা উচিত ছিলো। আফগানিস্তানেও ভারত এই কাজ করেছিলো। তারপর তালেবান ক্ষমতায় যাবার পর আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে বড় হোঁচট খায় ভারত। তাই এই বাস্তবতা এখন ভারত বুঝে গেছে।
ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশী কূটনীতিকরা মনে করেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে। চার হাজার কিলোমিটারের বেশি অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে। সমুদ্রসীমা আছে। বাংলাদেশের মানুষ ভারতে বেড়ানো, চিকিৎসা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যোগাযোগ করে। তবে ভারতের দুশ্চিন্তা শুধু যে, রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে এমন নয়। নিরাপত্তাজনিত কারণও রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন পর্যায় থেকে সাংবাদিকদের কাছে এটা জানতে চাওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের এত মেলামেশা হচ্ছে কেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তি সরকারের সম্পর্কের ধরন কী কিংবা সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কী পরিকল্পনা। এসব বিষয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে যে খুব বেশি কিছু জানতে পেরেছে এমন নয়। কারণ এসব বিষয় সত্যি সত্যি কিছু হচ্ছে নাকি ‘পলিটিক্যাল রেটরিক’ তা এখনই স্পষ্ট আলামত আকারে সামনে আসছে না।
দিল্লি সফরের পর সাংবাদিক প্রতিনিধি দল মুম্বাই সফর করেছে। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাই মূলত একটি কসমোপলিটান সিটি। এটি ভারতের অর্থনীতির হাব। ভারতের মাল্টি-ন্যাশনাল করর্পোরেট কোম্পানী যেমন টাটা, রিলায়েন্স, গোদরেজ প্রভৃতির সদর দফতর মুম্বাইয়ে অবস্থিত। ব্যাংকিংখাতের অনেক সদর দফতর মুম্বাইয়ে অবস্থিত। মুম্বাই সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের যোগাযোগ আছে। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে ছত্রপতি শিবাজি মারাঠা সম্রাট হিসাবে মহারাষ্ট্র শাসন করেন। তার নামেই মুম্বাইয়ের বিমান বন্দরের নামাকরণ হয়েছে। মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বব্যাপি সুপরিচিত। যদিও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মুম্বাইয়ের অর্থনীতির হিসাবে বড় বিনিয়োগ নয়। তদুপরি মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে বলা হয় ওরেঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি যা সফট পাওয়ার হিসাবে ভারতের ইমেজ বৃদ্ধি করে। মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জও বিশ্বের অন্যতম প্রধান শেয়ারবাজার। মুম্বাইয়ের এই উন্নতির ধারায় বাংলাদেশও যোগ দিতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস শিল্প অনেক বিকশিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রে জয়েন্ট ভেঞ্চার হতে পারে। তবে বাংলাদেশ যদি মুম্বাইয়ের উন্নতির ধারায় যুক্ত হতে চায় তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক খুবই খারাপ। এই কারণে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, ভারতের সরকারী পর্যায় থেকে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সবাই মনে করছেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বর্তমান টানাপোড়েন সাময়িক। নির্বাচনের পর তা ঠিক হয়ে যাবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ঘিরে যত কথা চাউর হয়েছে; তার অন্যতম হলো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়। এখন ভারত যখন বলছে, নির্বাচনের পর যে সরকার ক্ষমতায় যাবে; তার সঙ্গেই কাজ করবে ভারত। এখন দেখা যাক, সকল সন্দেহ-সংশয় উপেক্ষা করে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয় কিনা। নির্বাচন হলে নতুন সরকারের সঙ্গে ভারত কাজ করবে কিনা। এখন এসব নিয়েই যত আলোচনা। ##