সিপিজিসিবিএলের টেন্ডারে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:৪০ এএম, ৮ অক্টোবর ২০২৫ বুধবার

মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) জুলাইয়ে টেন্ডার আহ্বান করে। কার্যাদেশ পেতে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান টেন্ডার শিডিউল ক্রয় করে। তখন টেন্ডারে যেসব শর্ত ছিল হঠাৎ করেই রহস্যজনক কারণে তাতে অনেক সংশোধনী আনা হয়। টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, সিপিজিসিবিএল কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিতে এমন একটি টালবাহানার আশ্রয় নিয়েছে। ৬ লাখ টাকা জমা দিয়ে টেন্ডার শিডিউল ক্রয় করার পর কেন প্রতিষ্ঠানটি তাতে পরিবর্তন আনল সে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
এটি একটি আন্তর্জাতিক টেন্ডার। ইন্দোনেশিয়া থেকে দেশীয় কোম্পানির মাধ্যমে কয়লা আমদানি করতে সিপিজিসিবিএল এ সংক্রান্ত কাজে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে টেন্ডার আহ্বান করে। এতে এরই মধ্যে টেন্ডারে অংশগ্রহণের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান টেন্ডার শিডিউল ক্রয় করেছে। ৯ অক্টোবর টেন্ডার ওপেনের তারিখ নির্ধারণ করেছে সিপিজিসিবিএল। কিন্তু সিপিজিসিবিএলের কয়েক দফা সংশোধনীর কারণে হাতেগোনা দু-একটি প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণের সুযোগ পাবে। আর এটি করা হলে পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া কোনোভাবেই অংশগ্রহণমূলক হবে না বলে মনে করছে অন্যান্য অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান।
তাদের অভিযোগ, মাতারবাড়ী ২x৬০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা আমদানির টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিত্যনতুন শর্তজুড়ে নির্দিষ্ট কোম্পানিকে সুবিধা দিতে কারসাজি করছে সিপিজিসিবিএল। সূত্রে জানায়, টেন্ডারের কাঠামো নতুন করে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, হাতেগোনা দুটি কোম্পানি ছাড়া বাকিদের প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণ অসম্ভব। অনেকের আবার সক্ষমতা থাকলেও টেন্ডারে নতুন শর্ত মোতাবেক ডকুমেন্টস সরবরাহের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া হচ্ছে না। একই ধরনের অভিযোগ অতীতে রামপাল ও মাতারবাড়ী-১ প্রকল্পেও ঘটেছিল।
জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে সিপিজিসিবিএল টেন্ডার আহ্বান করে। এর প্রায় ২০ দিন পর ইনভাইটেশন টু বিডার (আইটিবি) ডকুমেন্টের ক্লজ ৫.৩-এ পরিবর্তন আনা হয়। কনসোর্টিয়ামের একজন পার্টনারকে ‘লিড পার্টনার’ হিসাবে ঘোষণার যোগ্যতায় নতুন সংযুক্তি আনা হয়। এখানে আর্থিক মানদণ্ডের অন্তত ৪০ ভাগ এককভাবে পূরণকে সংশোধনী-১ এর মাধ্যমে আরও কঠোর করা হয়। টেকনিক্যাল ক্রাইটেরিয়া সংযুক্ত করে বাংলাদেশি কোম্পানির অংশগ্রহণকে হাতেগোনা কয়েকটি জাহাজ কোম্পানির মাঝে সীমিত রাখা হয়।
বিদ্যুৎ খাতের একজন সাবেক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে কয়লা খনির মালিক নেই বিধায় এ ধরনের টেকনিক্যাল ক্রাইটেরিয়াবিশিষ্ট শর্ত মাদার ভেসেল মালিকদের আর্থিক সুবিধার জন্য রাখা হয়। যাতে প্রতিযোগিতা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে একচেটিয়া হয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল টেন্ডারের শর্তে মাতারবাড়ি ২x৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মোট সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা প্রতিবছর প্রায় ৩.৫ এমএমটি। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড টেন্ডার শিডিউল ক্রয় করা প্রতিষ্ঠানকে বলছে, টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীকে বছরে কমপক্ষে ৩.৫ এমএমটি কয়লা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এ ছাড়া সরবরাহের ধারাবাহিকতা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
সিপিজিসিবিএলের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠান বলছে, প্রতিষ্ঠানটির (সিপিজিসিবিএল) উপরোক্ত ব্যাখ্যাতেই কয়লার চাহিদা ৩.৫ মিলিয়ন টনের কথা রয়েছে। পরে তা ১০.৫ মিলিয়ন টনে পরিণত করা হয়। যা প্রকল্পের প্রকৃত প্রয়োজনের তিনগুণ। এভাবে তিনটি খনিকে সমপরিমাণ সরবরাহে বাধ্য করা অবাস্তব ও প্রতিযোগিতাবিরোধী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন তারা। অভিযোগ করে তারা বলেন, প্রথমত এ বিষয়টি সংশোধনী আকারে প্রকাশ করা হয়নি। বরং টেন্ডারের জন্য প্রাক-মিটিং আলোচনার প্রশ্নোত্তর পর্বের একটি প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ই-মেইল মারফত এটি জানানো হয়েছে। যা টেন্ডারের যোগ্যতা ও প্রতিযোগিতার কাঠামো সম্পূর্ণ পালটে দেওয়ার প্রচেষ্টার একটি অংশ।
তারা বলেন, সিপিজিসিবিএল টেন্ডার প্রকাশের সময় এইচবিএ ইনডেক্স ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও পরে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভুল বুঝতে পারে। তারা টেন্ডার জমা নেওয়ার দুই সপ্তাহ আগে দামের সারণির (প্রাইস ইনডেক্স) মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবর্তন আনে। এই পরিবর্তনের ফলে দুটি জাহাজ কোম্পানি ছাড়া বাকিদের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এমন বাস্তবতায় টেন্ডার শিডিউল কিনেছেন এমন বেশ কয়েকটি কোম্পানির পক্ষ থেকে ৯ অক্টোবর টেন্ডার খোলার তারিখ পরিবর্তন করে তাদের সময় বাড়ানোর অনুরোধ করলেও রহস্যজনক কারণে সিপিজিসিবিএল তা অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে।
কয়লা সরবরাহে টেন্ডারের জন্য দুটি কোম্পানিকে সুবিধা প্রদান করতে টেন্ডার আহ্বানের অনেক পর তাতে নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়-এমন অভিযোগ শুনে সিপিজিসিবিএলের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (ইডি) কেএম রিসালাত রাজীব যুগান্তরকে বলেন, নাউজুবিল্লাহ। আমরা এ ধরনের কোনো কিছু করছি না।
টেন্ডারের সংশোধনী পূরণ করে অপরাপর কোম্পানিকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়াকে আরও অংশগ্রহণমূলক করা হবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা ইন্দোনেশিয়ার কোম্পানির নিয়ম অনুসারেই সংশোধনীগুলো এনেছি। বর্তমানে আমাদের হাতে সে অর্থে সময় নেই। এখনই কাজ শুরু করা না গেলে এবং সময়মতো কয়লা না এলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকার সম্ভাবনা আছে। একদিন যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকে তাহলে ৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
কেএম রিসালাত রাজীবের এমন তথ্যের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুনভাবে টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের জন্য সময় বাড়ালে দৈনিক ৬ কোটি টাকা লস হবে না। কারণ এখন যে প্রতিষ্ঠান সেখানে কয়লা সরবরাহ করছে তারা নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত কয়লা সরবরাহ করবে। এমন শর্তে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানটি টেন্ডার পেয়েছিল। ফলে কেএম রিসালাত রাজীব যে লসের কথা বলছেন সেটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বেশি পরিমাণ প্রতিযোগীকে টেন্ডারে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে সময় বাড়ানো হবে কিনা-এমন প্রশ্নে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল হক যুগান্তরকে বলেন, নতুন ক্রাইটেরিয়া বা শর্তের বিষয়গুলো টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের এখন থেকে ২০-২৫ দিন আগে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার যদি সময় বাড়ানোর বিষয়ে বলা হয়, তাহলে তার জন্য পলিসি আছে। সেটার জন্য বোর্ডের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নতুন কন্ট্রাক্টে আমাদের যেতেই হবে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সকালে তিনি ব্যস্ত বলে জানান। তার পিএস আবদুল্লাহ মনসুর যুগান্তর প্রতিনিধির ফোন রিসিভ করে বলেন, যুগান্তর থেকে সচিব মহোদয়ের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। তবে তিনি একটি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। তাই এখন কথা বলতে পারছেন না। মিটিং শেষ হলে ফোনে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন বলে জানান পিএস। মঙ্গলবার রাতের দিকে সচিবের ফোন নম্বরে ফোন করলে তার পিএস ফোন রিসিভ করে বলেন, সচিব মহোদয় জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। এখন কথা বলতে পারবেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায় মাতারবাড়ী ও রামপাল প্রকল্পে একাধিক কয়লা সিন্ডিকেট গঠিত হয়েছিল। যেখানে বিদেশি সরবরাহকারী ও স্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীর যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম হয়। এমনকি ২০২৪-২৫ সালে এক অনুসন্ধানে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা চালানে ৩০ কেজি ওজনেরও পাথর পাওয়া গিয়েছিল। আরেক প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, সরবরাহকারী সংস্থা নিজের শর্তে পণ্য খালাস করতে চেয়েছিল। একই ধরনের অনিয়ম পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লাসংক্রান্ত টেন্ডারেও ধরা পড়ে। এ কারণে অনিয়ম তদন্তে তখন সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে। এমনকি টেন্ডার বাতিলেরও নির্দেশ দেয়।
বিদ্যুৎ খাতের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের টেন্ডার নিয়ে নতুন পদক্ষেপের পেছনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ও কোম্পানি তথা সিপিজিসিবিএলের বোর্ড অব ডিরেক্টরদের কারও কারও প্রভাব থাকার অভিযোগ উঠেছে। তাদের সিদ্ধান্তেই সিপিজিসিবিএল রহস্যজনক কারণে টেন্ডার কাঠামো ও শর্ত পরিবর্তন করেছে বলে মনে করছেন তারা।
ইউরোপীয় আদালতের Commission v. Belgium (C-87/94) রায় অনুযায়ী, দরপত্র প্রকাশের পর যোগ্যতার শর্ত পরিবর্তনকে ‘স্বচ্ছতা ও সমতার নীতির পরিপন্থি’ ধরা হয়। পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অনিয়মের আশ্রয় নিতে এমন কিছু করছে কিনা সেটা চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান অংশীদার জাইকার অর্থায়নে নির্মিত প্রকল্পের এ ধরনের দুরবস্থা, আগামীতে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও ঋণ প্রতিবন্ধকতাসহ অন্যান্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মাতারবাড়ী-২ প্রকল্পটি দেশের অন্যতম জাতীয় কৌশলগত উদ্যোগ; যেখানে স্বচ্ছতা, প্রতিযোগিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা আবশ্যক। টেন্ডারে নতুন শর্ত আরোপ, অঘোষিত পরিবর্তন ও নথি সংশোধনে পক্ষপাতিত্ব এবং ভবিষ্যতে অযাচিত প্ররোচনা সৃষ্টি করে কয়লা সরবরাহ সম্পর্কিত কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলেও মনে করেন তারা।