মঙ্গলবার   ২৮ অক্টোবর ২০২৫   কার্তিক ১২ ১৪৩২   ০৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

প্রবাসী বাংলাদেশের রাজনীতি কার স্বার্থে?

আজকাল রিপোর্ট -

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৫০ এএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার

 

 
প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনীতি কার স্বার্থে? দেশ থেকে আগত নেতানেত্রীদের পকেট ভারিকরণ? নাকি ঢাকায় গিয়ে ব্যবসা বানিজ্য হাতিয়ে নেবার কৌশল মাত্র। পতিত হাসিনার সরকারের আমলে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বিপুল অর্থ বৈভরে মালিক হয়েছেন। নিজাম চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী ও ড.নুরুন্নবীর নাম সকলেরই জানা. ড. সিদ্দিকুর রহমান হয়েছিলেন কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের মালিক। ব্রুকলিনের এক নেতা তো এখনও জেলখানায়। এমপি হয়েছেন আব্দুস সোবহান গোলাপ। এহসানুল হক মিলন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গিয়ে এমপি মন্ত্রী হন। এমএম শাহিন হয়েছিলেন এমপি। বর্তমানে বিএনপির ডজন খানেক নেতা এমপি হবার জন্য ঢাকা -নিউইয়র্ক দৌড়াদৌড়ি করছেন। তাদের মধ্যে মিল্টন ভূইয়া, জিল্লুর রহমান, আব্দুল লতিফ সম্রাট, সোলায়মান ভূইঁয়া ও সেলিম রেজার নাম শোনা যাচ্ছে। একই অবস্থা যুক্তরাজ্যেও। বিভিন্ন দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও আদর, সেবা ও আতিথেয়তা পাবার প্রত্যাশায় এসব প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। নেতারা ব্যাগ বানিজ্য করতে ভুলে যান না। 
প্রবাসের রাজনীতি নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে,দেশে সংঘর্ষ-সহিংতার রাজনীতির যে চর্চা দেখা যায়, বিদেশের মাটিতেও আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের রাজনীতি এভাবেই কেন চলছে-।এই প্রশ্নে নতুন করে আলোচনা বা বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে প্রবাসীদের দলাদলি এমনকি সংঘর্ষে জড়ানোর অনেক অভিযোগ উঠেছে।

সর্বশেষ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী এনসিপি নেতা আখতার হোসেনের ওপর নিউইয়র্কে ডিম নিক্ষেপ বা হেনস্তা করার ঘটনায় সেখানে দেশি রাজনীতির উত্তাপ ছড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে ভৌগোলিক সীমানার বাইরে দেশের রাজনৈতিক দলের শাখা বা কমিটি গঠনে বিধি-নিষেধ থাকলেও তা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। বরং বিদেশে অব্যাহতভাবে চলছে দেশীয় রাজনীতির সমর্থনে দলাদলিসহ নানা তৎপরতা। আর এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার সাথে থাকা বা ব্যক্তিস্বার্থ বড় একটা বিষয় এবং একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোরও দায় রয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা।

এখানে উদাহরণ টানলে দেখা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একজন নেতা দেশে এসে ওই দলের মনোনয়নে সিলেটে মেয়র হয়েছিলেন। অনেকের এমপি হওয়ার গল্পও রয়েছে। এখন আবার জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিএনপি সমর্থক অনেকে দেশে এসেছেন, অনেকে আছেন আসা-যাওয়ার মধ্যে।

যদিও কোনো রাজনৈতিক দলই বিদেশে দেশীয় রাজনীতির তৎপরতা বা দলাদলি সমর্থন করে না-- এমন বক্তব্যই দিচ্ছেন নেতারা। কিন্তু তারা তাদের কথা ও কাজের ফারাকটা লুকাতে পারছেন না।

দেশের বাইরে দলীয় কর্মকাণ্ড বন্ধে কোনো দলের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং তারা ফায়দা নিচ্ছেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা দাবি করেন, অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিলেও তারা নিজ দেশের উন্নয়নের জন্য, অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বার্থে এই রাজনীতি করছেন। কিন্তু সাধারণ চোখে দেখলে ব্যক্তি ও দলের নেতাদের স্বার্থ সেখানে বড় বিষয় বলে মনে হয়। আর ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষেত্রে বড় লক্ষ্য থাকে নিজ দেশে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা। লন্ডন ও নিউইয়র্কে একাধিক প্রবাসী সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেও এমন ধারণা পাওয়া যায়।


২০২৩ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে মেয়র নির্বাচিত হন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। বিলেত থেকে এসে তার মেয়র প্রার্থী হওয়ার ঘটনায় খোদ আওয়ামী লীগের সিলেটের নেতা-কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, জানিয়েছিলেন প্রতিবাদ। কিন্তু সে সময় স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সেই ক্ষোভ-প্রতিবাদ আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।

অভিযোগ রয়েছে, শীর্ষ নেতৃত্বের আশীর্বাদে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী লন্ডন থেকে দেশে এসে সিলেটে দলটির মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন।
তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতন হলে দেশ ছেড়ে আবার লন্ডন চলে গেছেন মি. চৌধুরী।

লন্ডন থেকে আরেকজনের দেশে এসে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে এমপি হওয়ার গল্পটা আরও চমকপ্রদ। জানা গেছে, ওই ব্যক্তির লন্ডনে একটি কমিউনিটি হল আছে। সেই হলে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এর জন্য কোনো অর্থ নিতেন না ওই ব্যক্তি। এর প্রতিদান তিনি নিয়েছিলেন এবং দেশে এসে আওয়ামী লীগের টিকেটে এমপি হয়েছিলেন।

বিদেশে থাকা বিএনপির সমর্থকদের ক্ষেত্রেও অনেক উদাহরণ আছে এবং এখন নতুন করে তৈরি হচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিগত আওয়ামী লীগের শাসনের সময়টাতে ১৭ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেকারণে যুক্তরাজ্যে বিএনপির সমর্থকদের তৎপরতা ছিল বেশি।

দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর লন্ডন থেকে বিএনপির অনেকেই এখন দেশে এসেছেন। শুধু যুক্তরাজ্য নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে বসবাসকারী বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত অনেকেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার চিন্তা থেকে বাংলাদেশমুখী হয়েছেন বলে দলটির সূত্রে জানা গেছে।

লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক বুলবুল হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পেছনে নানা বাস্তবতা কাজ করে। কেউ কেউ বাংলাদেশে ক্ষমতা কাঠামোর কাছাকাছি থাকতে চান, কেউ আবার দেশে জমি রক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা তদবিরের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হন।

যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রটাও একইরকম বলে জানিয়েছেন নিউইয়র্কের একাধিক সাংবাদিক। বিদেশে থেকে দেশি রাজনীতিতে সম্পৃক্তদের একটা অংশের কাছে দেশে সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা করাটা বড় বিষয়। দেশের বড় কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলে সেটা করা সম্ভব বলে তাদের ধারণা।
প্রবাসে যারা দেশের কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেই দল ক্ষমতায় গেলে তাদের জন্য তদবির করা সহজ-- বলছিলেন লন্ডনে বসবাসকারী একাধিক বাংলাদেশি। এর কারণ ব্যাখ্যায় তারা বলেন, দেশে মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে দেখা করা বেশ কঠিন।

কিন্তু দলের নেতারা যখন লন্ডনে আসেন, তখন সেখানকার সমর্থকেরা তাাদের সংবর্ধনা দেওয়াসহ যথেষ্ট সময় দিয়ে থাাকেন। এগুলোও এক ধরনের বিনিয়োগ। সেই নেতারা মন্ত্রী-এমপি হলে অতীতের বিনিয়োগের প্রতিদান পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ফলে অনেকে তদবির বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন।


এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে নাগরিকত্ব পেয়ে যারা বসবাস করছেন, তাদের একটা বড় অংশ ওই দেশগুলোর মূলধারার রাজনীতিতে যেতে পারেন না বা সেভাবে অবস্থান তৈরি করতে পারেন না। তাদের অনেকে সেখানকার কমিউনিটিতে প্রভাব তৈরি করা এবং দেশে সুবিধা পাওয়ার ব্যক্তিস্বার্থ থেকে দেশি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। একেবারে রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করেও অনেকে দেশি রাজনীতিতে যুক্ত রয়েছেন। তবে সেই সংখ্যাটা অনেক কম। এমন ধারণা পাওয়া যায় প্রবাসীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে।

আরেকটি অংশ আছেন, যারা অবৈধভাবে ওই দেশে যান, তারা রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন। তারা তাদের অবস্থানের কারণে দেশি রাজনীতির সঙ্গ যুক্ত হন। দলগুলোরও স্বার্থ রয়েছে। কোনো কোনো দলের জন্য ডোনেশন বা আর্থিক সহায়তা পাওয়ার একটা বিষয় রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকেরা বলছেন।
তবে বিদেশে দলের তৎপরতায় জামায়াতে ইসলামী কৌশল একেবারে ভিন্ন। দলের নাম দিয়ে বিদেশে তাদের কোনো তৎপরতা নেই। জামায়াতের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দলীয় নাম বাদ দিয়ে সামাজিক, স্বেচ্ছ্বাসেবক, মুসলিম উম্মাহসহ বিভিন্ন নামে বা ব্যানারে তৎপরতা চালায়।
প্রবাসীদের রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বিদেশেও তৎপরতা চালানোর ক্ষেত্রে কৌশলী জামায়াত। কিন্তু অন্য দলগুলো প্রকাশ্যে দেশের ধারাতেই তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালায়। তাদের কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব অনেক সময় সংঘর্ষেও রুপ নেয়। আবার প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করার অনেক ঘটনা ঘটে বলেও অভিযোগ রয়েছে।