ব্যয় হয় না বরাদ্দের অর্থ, এডিপি তলানিতে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:০১ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রোববার

বাজেট শতভাগ বাস্তবায়ন যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে। অথচ প্রতি অর্থবছরেই বিশাল আকারের বাজেট দেওয়া হয়। অর্থবছরের শেষার্ধে তা সংশোধন করে কমানো হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, সংশোধিত বাজেটও বাস্তবায়িত হয় না। গত কয়েক বছর ধরে ঘোষিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা কম ব্যয় হচ্ছে। অর্থাৎ বাজেটের অর্থ ব্যয় করতে পারছে না সরকার। অর্থ বিভাগের ১০ বছরের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, প্রতিবারই বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। আগের ধরাবাহিকতা চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ১ শতাংশও বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবায়ন হয়েছে আধা শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি, অর্থাৎ মাত্র শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরিমাণের দিক থেকে জুলাইয়ে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা, আগের বছরের চেয়ে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো কম।
বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়েছেন খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূস। বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে গতি বাড়াতে কড়া বার্তা দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে এডিপি বাস্তবায়নের হার না বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করছে অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশন। সরকারি কোনো প্রকল্পের কাজে কাক্সিক্ষত গতি নেই। অর্থছাড় প্রক্রিয়া সহজ করা হলেও বরাদ্দ অর্থ খরচ করতে পারছে না মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। কিছু প্রকল্পের কাজ স্থগিত করা হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ এবং পুরনো প্রয়োজনীয় কোনো প্রকল্পই বাদ দেওয়া হয়নি। আবার প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তবু সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে তেমন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি গত এক বছরে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও জেঁকে বসা অনিয়ম-দুর্নীতির চক্র পুরোপুরি ভাঙতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকার। প্রশাসনের কোনো কোনো স্তরে এখনও দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ কর্মকর্তারা সক্রিয় রয়েছেন বলে মনে করছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও অর্থ বিভাগ। এ জন্য শেখ হাসিনার বিদায়ের বছর পেরিয়ে গেলেও বাজেট বাস্তবায়নের হার বাড়ানো সম্ভব হয়নি। বরং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার কমেছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের মধ্যে এডিপি বাস্তবায়নের আনুপাতিক হার বাড়াতে না পারলে দায়ী কর্মকর্তা বা প্রতিষ্ঠানকে ভর্ৎসনা করা হবে। কর্মকর্তার গাফিলতির প্রমাণ পেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে। একই সঙ্গে যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এডিপি বাস্তবায়নে বেশি পিছিয়ে রয়েছে, সেসব বিভাগে মনিটরিং জোরদারের নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ বিভাগ।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে বাজেট বরাদ্দের ৬০ শতাংশের কম খরচ হলে চতুর্থ প্রান্তিকে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে না বলে হুশিয়ারি দিয়েছে অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগের এক পরিপত্রে জানানো হয়েছে, অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে গিয়ে বাজেট খরচের হুড়োহুড়ি রোধে এই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেন না, শেষ সময়ে খরচ করতে গিয়ে প্রায়শই সরকারি অর্থের অপব্যবহার করা হয়। সরকারি সংস্থাগুলো তৃতীয় প্রান্তিকের মধ্যে নির্ধারিত কোটা পূরণে ব্যর্থ হলে, চতুর্থ কিস্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আটকে দেওয়া হবে বলে পরিপত্রে সতর্ক করা হয়েছে।
অর্থ বিভাগ জানায়, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অর্থবছরের শুরুতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর বাজেট বাস্তবায়নের গতি খুবই কম থাকে। কিন্তু শেষ প্রান্তিকে খরচ বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে অর্থবছরের শেষ দিকে প্রকৃত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখেই দ্রুত বরাদ্দের অর্থ ছাড় ও ব্যয় করা হয়। সেক্ষেত্রে প্রায়শই সঠিক প্রক্রিয়া না মেনে অর্থছাড় ও ব্যয় করা হয়। এতে সীমিত সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, অপচয় ও অনিয়ম হয় এবং সরকারি ব্যয়ের মান ক্ষুণ্ন হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে যা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা গত ৪৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র ৬৮ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এডিপির ১ শতাংশের কম বাস্তবায়িত হয়েছে। এর আগে সবচেয়ে কম বাস্তবায়নের রেকর্ড ছিল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে বাস্তবায়নের হার ছিল ৮০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এমনকি করোনা মহামারির লম্বা সময় লকডাউনে থাকার বছরও এর চেয়ে বেশি হারে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাস্তবায়ন ছিল ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ। বর্তমানে বাস্তবায়নের গতি কমে যাওয়ায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও অর্থ বিভাগ।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, প্রতিবছরই বাজেট বাস্তবায়ন অধরাই থেকে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, যা ইতিবাচক। অর্থবছরের শুরুতেই এ ধরনের উদ্যোগ বাজেট বাস্তবায়নে গতি এবং মান উভয়ই বাড়াবে।