রাষ্ট্রে গণতন্ত্র থাকলে বাস্তুতন্ত্র নিরাপদ থাকবে: তারেক রহমান
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:৪৮ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রোববার

রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে গণতন্ত্র এবং শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠিত থাকলে বাস্তবিকভাবেই বাস্তুতন্ত্র নিরাপদ থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন গণতন্ত্রের চর্চা ও সুরক্ষা প্রয়োজন, তেমনি প্রাণী অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা প্রয়োজন। প্রাণীকুলের মধ্যে এক ধরনের প্রাণীর আবাস কিংবা খাবারের ব্যবস্থা সাধারণত মানুষ করে থাকে। বন্যপ্রাণী হিসেবে যেসব প্রাণী চিহ্নিত, সেইসব নিজেরাই নিজেদের আবাস কিংবা খাবারের ব্যবস্থাগুলো করে থাকে। এইসব প্রাণীর জন্য বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিধান আসলেই অত্যন্ত জরুরি।
শনিবার রাজধানীর চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘প্রাণী ও প্রাণের মিলন মেলা’য় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। দিনব্যাপী ব্যতিক্রমী এই মেলার আয়োজন করে বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। ‘দেশ হোক সকল প্রাণের নিরাপদ আবাসস্থল’ এই স্লোগানে সকাল থেকে প্রায় ৪০ প্রজাতির পশু-পাখি মেলায় প্রদর্শনী হোক। পশু-পাখি প্রেমীরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মেলায় অংশ নেন। অনুষ্ঠানে দুটি পর্ব ছিল—প্রথম পর্বে সকাল ১০টা থেকে নানা ধরনের প্রাণী প্রদর্শন করা হয় এবং দ্বিতীয় পর্বে বিকাল ৪টা থেকে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
তারেক রহমান বলেন, প্রাণীর নিরাপত্তা, অধিকার রক্ষা, মানব সভ্যতার উৎকর্ষতা এবং বিকাশের পর্যায় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রাণীর নিরাপত্তা এবং অধিকার রক্ষার বিষয়টি নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রাণী অধিকারের যে বিষয়টি, শুধুমাত্র প্রাণীদের প্রতি মানবিক দায়িত্বই নয় বরং জীব বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষা, মানবজাতির নিজেদের সুস্থ এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করাও অত্যাবশ্যক।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র মানবিক কিংবা সামাজিক কারণেই নয়, সৃষ্টিকূলে পশুপাখি-প্রাণীর কথা সকল ধর্মেই গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে। প্রাণীজগতকে প্রকৃতি এবং পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটি ধর্মের অবস্থান থেকেও করা হয়েছে। বিভিন্ন মনীষীও বিভিন্ন সময়ে সেটি তাদের বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন প্রাণীর নামে অনেক সুরার নামকরণও করা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ বলছেন— ‘প্রাণিকুল সৃষ্টির (অন্যতম) কারণ হলো, এগুলোতে তোমরা আরোহণ করে থাকো আর এগুলো সৌন্দর্যের প্রতীক।’ আরও বলা হয়েছে— ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী আছে আর যত পাখি দুই ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, তারা সবাই তোমাদের মতো একেক জাতি।’
বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, পশুপাখি কিংবা বন্যপ্রাণী অর্থাৎ সৃষ্টি জগতের প্রতিটি সৃষ্টিই একে অপরের জন্য উপকারী। মানব সমাজের বিকাশে প্রতিটি পশুপাখি কিংবা বন্য প্রাণীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। এডিস মশার লার্ভা খেয়ে মশার বিস্তার রোধ করতে সাহায্য করে। সুতরাং, এই বিষাক্ত মশার বিস্তার রোধের জন্য বিশেষ করে শহরে-নগরে ব্যাঙের জন্য নিরাপদ আবাস অর্থাৎ জলাশয় থাকা প্রয়োজন। এভাবে মানব সমাজের নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রতিটি প্রাণের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারাল রিসোর্স অর্থাৎ আন্তর্জাতিক প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের একটি সংস্থা আছে। প্রায় এক দশক আগে তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে—এই দেশে ১,৬০০-এর বেশি প্রজাতি প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৯০টি প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে চলে গিয়েছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের আরও অনেক দেশেই মানুষের সৃষ্টি পরিস্থিতির কারণে অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন।
তারেক রহমান বলেন, বাংলাদেশের গর্ব যেটা—আমাদের ঐতিহ্যবাহী প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বাঘও এখন বিলুপ্ত প্রজাতির তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে। আমার যতটুকু মনে আছে, ৮০’র দশকে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০-এর কাছাকাছি। সর্বশেষ জরিপে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ১০০-এর কাছাকাছি। হাতির সংখ্যাও এখন কমে ২০০-এর নিচে চলে এসেছে। এভাবে বাংলাদেশের আরও অনেক প্রাণী ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে বিলুপ্ত প্রজাতির তালিকায়।
তিনি আরও বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদী-জলাভূমি ভরাট, বন উজাড়সহ নানা কারণে জীববৈচিত্র্য যেমন হুমকির মুখে পড়ছে, ঠিক একইভাবে বন্য প্রাণী পাচারের ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এসব কারণে বন্য প্রাণী, জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের আবাসস্থল অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা আইন, পরিবেশ উন্নয়ন আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশের অনেকগুলো আইন রয়েছে। জনগণের রায় বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে পশুপাখি, বন্যপ্রাণী তথা বাস্তুতন্ত্রের নিরাপত্তার জন্য এসব আইন সময়োপযোগী করা হবে। অনেকগুলোর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন প্রয়োজন রয়েছে।
তারেক রহমান বলেন, আমার মনে হয়, দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে একজন মানুষ, একজন নাগরিক হিসেবে সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার হারানোর কারণে আমাদের অনেকের মনে হয়তো এক ধরনের অসহিষ্ণুতার জন্ম নিয়েছে। এই অসহিষ্ণুতা কাটিয়ে একজন মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার জন্য মনুষ্যত্ব অর্জন আর পশুত্ব বর্জনই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, পৃথিবীর অলংকার হলো প্রাণীকূল। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণীকূলকে রক্ষা করতে হবে। এই বিষয়ে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।
প্রাণীদের রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন যুগান্তর সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার। তিনি বলেন, রাজধানীতে শিশুদের জন্য কোনো পার্ক নেই। খেলাধুলা করতে পারছেন না। পর্যাপ্ত বিনোদন কেন্দ্র নেই। বাচ্চাদের প্রাণীর প্রতি ভালোবাসার পরিচয় করাতে হলে প্রাণের কাছে ফিরে যেতে হবে। মোবাইল রেডিয়েশনের কারণে প্রাণীরা বিলুপ্তির পথে। বন-জঙ্গল ধ্বংস হয়ে গেছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে আমাদের বন ও প্রাণী রক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে আগামী তরুণ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে খেলার মাঠ তৈরি করা জরুরি।
দেশের মানুষকে পশু ও ক্রীড়াপ্রেমী হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। তিনি বলেন, প্রাণীদের অধিকারের আদায়ে সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার হতে হবে।
আয়োজক সংগঠনের আহ্বায়ক চিত্রনায়ক আদনান আজাদের সভাপতিত্বে এবং সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম রনি, আমরা বিএনপি পরিবারের সদস্য মুস্তাকিম বিল্লাহ ও লোভা আহমেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির কোষাধ্যক্ষ এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন তুহিন, বাংলাদেশ অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উদ্যোক্তা আতিকুর রহমান রুমন, বিএনপির সহ স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আক্তার প্রমুখ।