ডাকসু নির্বাচন বিএনপির জন্য সতর্কবার্তা
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৪২ এএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয় বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিশেষ করে বিএনপির জন্য এক সতর্কবার্তা। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অনেকে মনে করেন, এই দুই নির্বাচন অনেকটা অবিশ্বাস্য ভোট বিপ্লবের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের প্রকাশ্য কোনও তৎপরতা ছিল না। গত বছরের অভ্যূত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র শিবির প্রকাশ্যে কমিটি করতে দেখা যায়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে শিবির নিজেদের নিয়ন্ত্রণের নিয়ে গেল তা সত্যি অবিশ্বাস্য।
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন ইসলামী ছাত্র শিবির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। গত বছরের জুলাই আগস্টের অভ্যূত্থানে শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় ছাত্ররা। ছাত্রদের এই আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার ইসলামী ছাত্র শিবির। ফলে তাদের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর প্রভাব থেকে যায়। তাছাড়া, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের মতো প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। এই ধরনের বহুবিধ কারণে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বিকল্প কিছু ভাবনা করছে ইইউ। সাধারনভাবে মনে করা হচ্ছে, বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হবে। কিন্তু গোপনে ব্যালট বিপ্লব হলে ভিন্ন ফল হলে তা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করতে পারে। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিবেশি ভারতের জন্য তা দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। কারণ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানপন্থী দল। এই দলের সঙ্গে ভারতের মিলেমিশে থাকা কঠিন। পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগও তাই আগামী নির্বাচনে কোনও না কোনও ভূমিকা পালন করতে পারবে। এ সবই মূল প্রশ্ন। তবে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফল আগামী নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রভাব হবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্যে সতর্কবার্তা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলে সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র একবারই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। ওই নির্বাচন ঘিরেও ছিল নানা বিতর্ক, নানা প্রশ্ন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ শাসনামলে ডাকসু কিংবা কোনো ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, যে কারণে অনেক বছর ধরে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা ভোটাধিকার চর্চার সুযোগ পাননি। আর সে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন পটভূমিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "চব্বিশের আন্দোলন শুরু করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ কেউ এখন অর্ন্তর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদেও রয়েছেন। যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ডাকসু নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হামলার পরই গত বছরের জুলাইয়ে সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ওই আন্দোলনই এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছিলেন, বিশেষ করে দুইটি কারণে এবারের ডাকসু নির্বাচন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রথম কারণ অনেকদিন পরে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত জুলাই পট পরিবর্তনের পর দেশের মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তার দুয়ার খুলে গেছে। যে কারণে এই নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরার একটা অংশ মনে করা হচ্ছে।
এখন থেকে প্রায় চার দশক আগে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদর রহমান মান্না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলনে ডাকসু সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দেশের ক্রান্তিলগ্নেও ডাকসু নেতৃত্ব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দিয়েছে। যে কারণে ডাকসুর আবেদন ও গুরুত্ব সব সময় ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ডাকসুতে ২৮টি পদের নির্বাচনে ৪৭১ প্রার্থীর মধ্যে ৬২ পদে প্রার্থী হয়েছেন ছাত্রীরা।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। ডাকসুতে ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। একই সাথে জুলাই আন্দোলনে তার দলের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়ার অতীতে বিভিন্ন সময়ে ডাকসুতে যারা ভিপি- জিএস কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে বিজয়ী হয়েছেন তাদেরও রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা গেছে। যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোও এবার এই নির্বাচনকে অনেক আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "ডাকসু নির্বাচনকে সারাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, এতে কোন সন্দেহ নেই। এই নির্বাচন কমবেশি জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবেই"।
ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে নিয়মিত টকশো, আলোচনা, বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করতে দেখা গেছে।
নির্বাচনি প্রচারণা শুরুর পর ছাত্রদল-ছাত্রশিবির-কিংবা প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর মধ্যে নানা অভিযোগ পাল্টা অভিযোগও করতে দেখা গেছে।