শনিবার   ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫   ভাদ্র ২২ ১৪৩২   ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলাদেশে ভোটের আগে অস্থিরতা

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৩৮ এএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার


 

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উত্তেজনা, সংঘর্ষ এমন কি সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। একদিকে চলছে মব সহিংসতার ঝড়। অন্যদিকে, রাজনৈতিক অনিশ্চিত পরিস্থিতি। সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিতে এসে মবের শিকার হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকীসহ বেশ কয়েকজন। জাতীয় পার্টির অফিসেও মব হামলা হয়েছে যাতে অনেকে আহত হয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনে মেয়েদের বিরতিহীন সাইবার বুলিং চলছে। দূর্গাপূজার আগে সাম্প্রদায়িক ঘটনার আশঙ্কা পুলিশের রয়েছে। এদিকে, ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরের ওপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হামলাকে ২০২৪ সালের গণঅভ্যূত্থানের পক্ষের দল ও নেতারা উদ্বেগজনক বলে অভিহিত করছেন। এসব কিছুর মধ্যেও নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন ধাপ ঘোষণা করেছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে।
অর্ন্তবর্তি সরকার এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে কাজের ক্ষেত্রে কিছুটা সমন্বয়হীনতার ছাপও মাঝে মধ্যে চোখে পড়ছে। সম্প্রতি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান পৃথকভাবে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। গুলশানে প্রধান বিচারপতির বাসায় গিয়ে জেনারেল কী বিষয়ে আলাপ করেছেন তা কোনও পক্ষ প্রকাশ করেনি। মিডিয়ায় বৈঠকের খবর চাউর হলে বৈঠকের খবর কেউ অস্বীকারও করেনি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এবং আইএসপিআর পৃথক বিবৃতি দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা সেনাবাহিনীর কমান্ডিং লাইনের বিষয়টি নির্দিষ্টকরণের প্রতি জোর দিয়েছেন। নির্বাচনের সময়ে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় কীভাবে সেনাবাহিনী কাজ করবে সেই দিকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অপরদিকে, আইএসপিআর বলছে, সেনাপ্রধান চীন সফর করে ফিরে সফরের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেছেন। উল্লেখ্য, এই সময়ে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসিসহ সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে রদবদল হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অর্থাৎ পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগেই নির্বাচন আয়োজনের কথা বারবার ব্যক্ত করছেন। কিন্তু তবুও আশঙ্কা দূর হচ্ছে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখেই নির্বাচন হবে। কারণ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সরকার স্থগিত করেছে। নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধনও স্থগিত করেছে। তবে জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করা দলসমূহ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। কারণ জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা হয়েছে। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদি দলসহ জোটের দলগুলোর কোনও কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগসহ তার জোটের দলগুলো বলছে যে, তাদেরকে নির্বাচনে সুযোগ না দেওয়া হলে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নির্বাচনের বাইরে থাকছেন। গণঅভ্যূত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্যে কতটা স্বস্তিদায়ক হবে সেটা বিবেচ্য বিষয়। নির্বাচন কমিশন পলাতক আসামীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে তা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংযুক্তির জন্য প্রস্তাব করেছে। এর ফলে যে সব আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তারা পলাতক থাকার কারণে ভোটে অংশ নিতে পারছেন না। কিন্তু যেসব আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে কোনও মামলা নেই কিংবা যাদের ক্লিন ইমেজ রয়েছে তারাও দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারছেন না।
আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ইতিমধ্যে তাদের কার্যক্রম স্থগিত থাকা সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকায় ঝটিকা মিছিল করেছে। রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে ধানমন্ডি ও বনানীতে আওয়ামী লীগ মিছিল করেছে। গণঅধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা চালালে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গণঅধিকার পরিষদের নেতা ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে নির্দয়ভাবে পেটায়। প্রায় অচেতন নুরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আইসিইউয়ে তার চিকিৎসা হয়েছে। নুরকে এভাবে পেটানোর ঘটনাকে রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ টার্গেট করে হামলা মনে করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে অভিহিত করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের ভয় হলো, নুরের মতো অন্য নেতারাও টার্গেট হতে পারেন। এই লক্ষ্যে অভ্যূত্থান ঘটানো দলগুলোকে এক থাকার আহ্বান জানানো হয়। রাজনৈতিক সংহতি প্রতিষ্ঠায় আজ ঢাকায় সমাবেশ হচ্ছে। অর্ন্তবর্তি সরকার এবং দলগুলোর প্রতিনিধিরা নূরকে দেখতে গেছেন। তার প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। অর্ন্তবর্তি সরকারের প্রধান তাকে বিদেশে পাঠিয়ে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। নূরের দুর্ভাগ্য হলো, শেখ হাসিনার শাসনামলেও তিনি শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নূরের আন্দোলনের ফসল সরকারের আমলেও নূর নির্যাতনের শিকার।
নির্বাচন কমিশন তাদের ঘোষিত কর্মপরিকল্পনা মোতাবেক সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকার হালনাগাদ, প্রবাসী ভোটার তালিকা প্রণয়ন, আচরণবিধি প্রণয়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। সংস্কার তথা জুলাই সনদ মতপার্থক্যের কারণে চূড়ান্ত হয়নি। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে বলছে। গণপরিষদ ভোটের কথাও বলছে। বিএনপি সাংবিধানিক সংশোধনী ভোটের পরে পার্লামেন্টে করার কথা বলছে। বিএনপি মাঠ পর্যায়ে ভোটের তোরজোর শুরু করলেও জামায়াত ও এনসিপি ভোটের প্রস্তুতি একদমই নিচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে জামায়াত ও এনসিপি ভোট বর্জনের চিন্তা করলে বিকল্প হিসাবে জাতীয় পার্টিকে রেডি রাখা হচ্ছে কিনা এমন আলোচনাও আছে। তবে আশা কথা হলো, বিএনপি’র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এনসিপি প্রতিনিধি দল গিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
অনেকে আবার বলছেন, দেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে। অক্টোবরে এ সংক্রান্ত রায় আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক মেয়াদ তিন মাস। ফলে এমন ক্ষেত্রেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন সম্ভব।
বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলার যে অবস্থা তাতে নিরাপত্তাহীনতা প্রবল। এই অবস্থার মধ্যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। কর্মসংস্থান নেই। একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে সবাই নির্বাচনের জন্যে চেয়ে আছে। সবাই আশা করছেন, নির্বাচিত সরকার দেশে স্থিতিশীলতা ফেরাবে।