বাংলাদেশের নেতার বার্তা : জেনারেশন জেড বিশ্বকে রক্ষা করতে পারে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৪৪ এএম, ২২ আগস্ট ২০২৫ শুক্রবার

ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ, ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেজারেট নিউজে একটি মতামতভিত্তিক নিবন্ধ লিখেছেন। ‘আ মেসেজ ফ্রম দ্য লিডার অব বাংলাদেশ : জেন জেড ক্যান সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামের নিবন্ধে ড. ইউনূস জেনারেশন জেডের শক্তি ও নেতৃত্বকে তুলে ধরেছেন এবং তাদের সময়কে মানবতার বৃহত্তর সংকটের মোকাবেলা করার সুযোগ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে গত বছর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সময়কার অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচন আয়োজনে তার প্রতিশ্রুতির কথাও তুলে ধরেছেন তিনি।
কালের কণ্ঠ তার পাঠকদের জন্য সম্পূর্ণ নিবন্ধটি বাংলায় ভাষান্তর করেছে :
“গত বছরের এই মাসে বাংলাদেশের সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হাজারো শিক্ষার্থী আমাদের সমাজের সর্বস্তরের অসংখ্য মানুষের সমর্থনে জাতির ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটায়।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ, যা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল, সেই আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা একজন স্বৈরশাসককে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য করে।
পরবর্তীতে ক্ষমতার শূন্যতার পরিস্থিতিতে ছাত্রনেতারা আমাকে আহ্বান জানালেন একটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে, যার দায়িত্ব হবে দেশকে স্থিতিশীল করা এবং গণতন্ত্রের পুনর্নবীকরণের পথ তৈরি করা। প্রথমে আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তু তাদের জোরাজুরিতে, আমি তাদের ও অসংখ্য তরুণের প্রাণ ও অঙ্গদানের কথা ভাবলাম।
আমি আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারিনি।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট আমি শপথ গ্রহণ করি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ও সুধী সমাজের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত একটি মন্ত্রিসভার সঙ্গে।
সরকারি চাকরিতে ন্যায্য নিয়োগ নিশ্চিত করার এক সাধারণ দাবি নিয়ে যা শুরু হয়েছিল, তা পরিণত হয় বিশ্বের প্রথম জেনারেশন জেড বিপ্লবে। এটি এখন এক মডেল, কিভাবে তরুণরা এগিয়ে এসে মানবতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো—যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বৈষম্য মোকাবেলা করতে পারে।
আমরা সৌভাগ্যবান যে তারা অপেক্ষা করার পথ বেছে নেয়নি। সভ্যতা যখন নানা দিক থেকে পথভ্রষ্ট হচ্ছিল, তারা বুঝেছিল যে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।
স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে আমাদের রূপান্তরের অন্যতম স্পষ্ট ইঙ্গিতগুলোর একটি ছিল দি ইকোনমিস্টের বাংলাদেশকে ২০২৪ সালের বর্ষসেরা দেশ ঘোষণা। অর্থনীতি পুনর্গঠন, নির্বাচন প্রস্তুতি ও লুট করা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ফেরত আনার কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে তখনো টের পাইনি বিশ্ব আমাদের অগ্রগতি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করছে। আমরা ডেজারেট নিউজে আমাদের যাত্রার চমৎকার কাভারেজেরও গভীরভাবে প্রশংসা করেছি।
আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর একটি ছিল নিশ্চিত করা যে পূর্ববর্তী শাসনামলে যারা নির্মমভাবে নিহতদের পরিবার এবং যারা আহত হয়েছেন—অনেকেই মারাত্মকভাবে, তারা যেন ক্ষতিপূরণ পান। একই সঙ্গে আমরা তাদের শোক ভাগাভাগি করছি। আমরা লুট হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, সেই শাসনামলে প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে, টানা ১৫ বছর ধরে। এ অর্থ ফেরত আনার লড়াই অত্যন্ত জরুরি; ঝুঁকিও বিশাল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি দুরবস্থার মাত্রা দেখে হতবাক হয়েছিলাম। পুলিশ তাদের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছিল। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল। গণতন্ত্র ধসে পড়েছিল। হাজারো মানুষ রাষ্ট্রীয় নির্যাতন কক্ষে বন্দি ছিল। সরকারি কর্মচারীরা, যারা শাসক দলের প্রতি আনুগত্য যথেষ্ট প্রদর্শন না করায় পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, তারা ন্যায়বিচার দাবি করছিল।
একটু একটু করে আমরা পুনর্গঠন শুরু করেছি। যারা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, সেই রাজনৈতিক দলগুলো এবং নতুন দলগুলো ধারণা, শক্তি ও পদক্ষেপ প্রদান করেছে। সশস্ত্র বাহিনী, যারা ৫ আগস্ট প্রশংসনীয় সংযম দেখিয়েছিল বিক্ষোভকারীদের হত্যার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, তারা পেশাদারি বজায় রেখেছে এবং আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করছে।
আমি স্পষ্ট জানিয়েছি, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী সরকারে আমি কোনো নির্বাচিত বা নিযুক্ত পদে দায়িত্ব পালন করব না।
আমাদের প্রশাসনের মূল মিশন হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের সামনে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে। সব যোগ্য নাগরিক যেন ভোট দিতে পারে, এমনকি যারা প্রবাসে আছেন তারাও, সেটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। তবে আমরা তা সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর।
আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিও নতুনভাবে সাজিয়েছি, যাতে প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক আরো জোরদার হয়।
বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির একটি মূল স্তম্ভ হতে পারে এবং হওয়া উচিত। আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ ট্রাম্প প্রশাসন ও সেক্রেটারি রুবিওর সমর্থনের জন্য। তার সঙ্গে আমি সম্প্রতি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে ফলপ্রসূ ও আন্তরিক আলোচনা করেছি, যা দুই দেশের জন্যই লাভজনক হতে পারে।
যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও জাতিসংঘও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা একা নই।
নির্বাচন প্রস্তুতির পাশাপাশি আমরা একটি ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব করেছি, যা বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের সঙ্গে বিস্তৃত পরামর্শের ভিত্তিতে গঠিত। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধানের সংশোধনী, যা শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নিশ্চিত করবে, যাতে বাংলাদেশ আর কখনো স্বৈরশাসনের হাতে না পড়ে।
আমি বাংলাদেশের তরুণদের, বিশেষ করে প্রবাসী প্রজন্মের ধন্যবাদ জানাই ও প্রশংসা করি। তারা দেখিয়েছে, কিভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া হতাশাকে পুনর্নবীকরণের নকশায় রূপান্তর করা যায়। তাদের সাহস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য প্রয়াস ও ত্যাগের প্রয়োজন।
তাদের দৃষ্টান্ত আশা জাগায় যে আরো বেশি জেনারেশন জেড সদস্য, পাশাপাশি তাদের দাদা-দাদি ও মা-বাবা, অর্থাৎ জেন এক্স, মিলেনিয়ালস ও আলফা প্রজন্মের তরুণ ডিজিটাল নাগরিকরা—আমার কথিত তিন শূন্যের বিশ্ব গড়ে তুলবে : শূন্য বেকারত্ব, শূন্য দারিদ্র্য ও শূন্য নিট কার্বন নিগর্মন।
বাংলাদেশ যদি অবশেষে এমন এক দেশে পরিণত হয়, যেখানে সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে, তবে তা সম্ভব হবে আগামী মাসগুলো ও বছরগুলোতে লাখ লাখ বাংলাদেশির দৃঢ় সংকল্প, কল্পনাশক্তি ও সাহসের কারণে।
যারা আমাদের সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়ার সৌভাগ্য ও দায়িত্ব বহন করছেন, যাদের মধ্যে ইউটাতে থাকা আমাদের অনেক বন্ধুও রয়েছেন, তারাই আমাদের সর্বোত্তম আশা এবং হয়তো শেষটিও।”