বৃহস্পতিবার   ২১ আগস্ট ২০২৫   ভাদ্র ৫ ১৪৩২   ২৬ সফর ১৪৪৭

অ্যাম্বুল্যান্স সিন্ডিকেটে জিম্মি রোগী ও স্বজনরা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৪৯ এএম, ২১ আগস্ট ২০২৫ বৃহস্পতিবার

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। বুকে ব্যথা নিয়ে জেলা সদর হাসপাতালে আসেন শৈলকুপার দুধসর গ্রামের কৃষক গোলাম নবী। চিকিৎসক তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে স্বজনদের দ্রুত ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। স্বজনরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স অন্য রোগী নিয়ে ঢাকায় গেছে।

তখন উপায় না পেয়ে প্রাইভেট অ্যাম্বুল্যান্স চালকের কাছে যেতে বাধ্য হন তারা। তখন অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা তাদের কাছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা দাবি করে। এমনকি সিরিয়াল অনুযায়ী নিম্নমানের অ্যাম্বুল্যান্সে যেতে বাধ্য করা হয় তাদের।

 

গোলাম নবীর ছেলে ফারুক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যত সময় পার হচ্ছিল বাবা ততই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন।

সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স না পেয়ে আমরা প্রাইভেট অ্যাম্বুল্যান্স ঠিক করতে যাই। তবে ওই অ্যাম্বুল্যান্সের চালকেরা আমাদের জিম্মি করে ফেলে। ফরিদপুরে যেতে সাধারণত ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাড়া হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে তারা সাড়ে ৭ হাজার টাকা ভাড়া নেয়।

এমনকি অ্যাম্বুল্যান্সের মান খুবই খারাপ ছিল। অনেক অনুরোধ করার পরেও তাঁরা কোনো কথা শোনেননি।’

 

সদর উপজেলার কুশবাড়িয়া গ্রামের আশরাফুল হোসেন সড়ক দুর্ঘনায় গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন জেলা সদর হাসপাতালে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসক তাকে দ্রুত ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। আশরাফুলের স্বজনরা ১২ হাজার টাকায় একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে রওনা দেন।

তবে সে অ্যাম্বুল্যান্সে গিয়েও তাঁরা প্রতারিত হন।

 

আশরাফুলের বাবা আব্দুল মজিদ বলেন, ‘ছেলের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ডাক্তারদের পরামর্শে তাকে ঢাকায় নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করি। অ্যাম্বুল্যান্সটি মাগুরার রামনগর এলাকা পার হওয়ার সময় ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে এমন একটি অ্যাম্বুল্যান্সে আমাদের তুলে দেয় চালক। এ নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করলে আমাদের দেড় ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখে। ছেলের অবস্থা খারাপ হওয়ায় অনেক অনুরোধ করে তাদের নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি আমাদের কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নেওয়া হলেও ঢাকার ওই অ্যাম্বুল্যান্স চালককে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার দেওয়া হয়েছে।’

 

গোলাম নবী, আশরাফুল ইসলামই নয় ঝিনাইদহ জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে প্রতিনিয়ত অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের কাছে প্রতারিত হচ্ছেন শত শত রোগী ও তাদের স্বজনেরা।

 

জানা গেছে, ঝিনাইদহ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে সংকটাপন্ন ৪০ থেকে ৫০ জন রোগীকে ফরিদপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। তবে হাসপাতালটিতে সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে মাত্র দুইটি। প্রতিদিন এত রোগী পরিবহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই অনেকে বাধ্য হন প্রাইভেট অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করতে। এ সুযোগে অ্যাম্বুল্যান্স চালকরা তাদের জিম্মি করে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে থাকে।

 

সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের এপ্রিলে ঝিনাইদহ জেলা অ্যাম্বুল্যান্স মালিক সমিতি গঠন করা হয়। এ সমিতির সভাপতি হন জাকির হোসেন। এরপর থেকে জাকির হোসেন জেলা সদর হাসপাতাল এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তির মালিকানাধীন অন্তত ২০টি অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। অ্যাম্বুল্যান্সগুলোর অধিকাংশই নিম্নমানের। জাকিরের নেতৃত্বে ওই সিন্ডিকেট মূলত অ্যাম্বুল্যান্স সেবার নামে বাণিজ্য করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। অনেক সময় রোগীদের জিম্মি করে মূল ভাড়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করেন তাঁরা। এসব বিষয় নিয়ে রোগীর স্বজনরা প্রতিবাদ করলে তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়।

 

অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা অ্যাম্বুল্যান্স মালিক সমিতির সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা নিয়ম মেনে অ্যাম্বুল্যান্স চালাই। অন্যান্য জেলাগুলোতে যেভাবে ভাড়া নেওয়া হয় আমরাও সেভাবে ভাড়া নিয়ে থাকি।’

 

সিভিল সার্জন ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘এটা হাসপাতাল এলাকার ঘটনা। সুতরাং এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ভালো বলতে পারবেন।’

 

তবে জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘লোকমুখে বিষয়টি শুনেছি। তবে এ নিয়ে কেউ কখনো আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি। খোঁজ নিয়ে পরে বিস্তারিত জানাতে পারব।’