মুনা কনভেনশন
বাংলাদেশি মুসলিমের মহাসম্মেলন
আজকাল রিপোর্ট -
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ১২:২৮ এএম, ১৬ আগস্ট ২০২৫ শনিবার

বিশ্বব্যাপী চলমান অশান্তি থেকে শান্তির পথে আসতে হলে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকার (মুনা) তিন দিনের কনভেনশন। গত ৮-১০ আগস্ট ‘পেনসিলভানিয়া কনভেনশন সেন্টার’-এ তিনদিনব্যাপী মুনা কনভেনশনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘টচবিয়ার্স অব ইসলাম, স্প্রেডিং দ্যা ফেইথ গ্লোবালী’।
কনভেনশনের উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ডের মধ্যে ছিলো সমসাময়িক নানা একাধিক সেমিনার, শিশুদের বিভিন্ন রাইড, ইসলামিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ইয়্যুথ প্রোগ্রাম, সিস্টার্স প্রোগ্রাম প্রভৃতি। এছাড়াও নিউইয়র্ক সহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য, বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলিম এ কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেন।
এবারের কনভেনশনে ভার্চুয়ালী বক্তব্য রাখেন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় আলেম ড. শায়খ মিজানুর রহমান আজাহারী। বিভিন্ন সেশনে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন, ইমাম দেলোয়ার হোসাইন, শেখ আবদুর রহমান খান, আবু সামিহা সিরাজুল ইসলাম, শেখ আবদুস সালাম আজাদী, ড. মহসিন আনসারী, ইমাম সিরাজ ওয়াহহাজ, শেখ মোহাম্মদ এলশিনাভি, ডা: আলতাফ হোসেন, ইমাম রাগাব আবদেলমোনেইন, শেখ মিকাইল আহমেদ, সামী হামদী, মোহাম্মদ ইলসেনওয়ে, ইমাম টম ফ্যাকইন, হামজাহ আব্দুল মালিক, আসিফ হাইরানী, আব্দুল নাসির জাংদা সহ আরো অনেক আলেম-ওলামা সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
বয়স্ক মুসলিম নর-নারীর পাশাপাশি শিশু-কিশোর-কিশোরী আর যুবকদের উপস্থিতও ব্যাপক পরিলক্ষিত হয়। তাইতো কনভেনশনে শিশু-কিশোর, ইয়ুথ ও নারীদের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান রাখা হয়। আরো ছিলো নতুন প্রজন্মের তরুণদের জন্য রোবটিক্স এআই এর মত অনুষ্ঠান। এছাড়াও তরুনী সিস্টার ও অ্যাডাল্ট পুরুষ-মহিলাদের জন্যও ছিলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান। ‘মেট্রোমোনিয়ল ডে’তে তরুণ ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যারা অবিবাহিত রয়েছেন তাদের ‘ম্যাচ মেকিং’ এর জন্য কিছু স্পেশাল পর্বও ছিলো। কলেজ পড়ুয়া বা বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত বিবাহযোগ্য ছেলে-মেয়েদের এই পর্বে যোগ দেন।
খুবই সাজানো এবং গুছানো তাৎপর্যপূর্ণ এবারের কনভেনশনটি যেন আমেরিকায় জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা পরবর্তী প্রজন্ম এবং বর্তমান প্রজন্মের সাথে ছিলো এক মিলন মেলা। অপরদিকে মুনা কনভেনশন ঘিরে সর্বস্তরের হাজার হাজার মুসলিম নর-নারীর উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে ফিলাডেলফিয়া শহর।
শুরু দিন জুম্মার নামাজে ইমামতি করেন ইমাম সিরাজ ওয়াহহাজ। পরবর্তীতে মূল মঞ্চে উদ্বোধনী পর্বের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন ক্বারী মোহাম্মদ জুনায়েদ হোসেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুনার ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর আরমান চৌধুরী। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন নিহাদ আওয়াদ, ইমাম মোহাম্মদ আলী, সাফা জারজুর, ড. ওসামা আবু আরশাদ, ড. আয়মান হাম্মুস, সালমান মুজাহিদ, ওসামা জামাল ও মুনার ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমাম দেলোয়ার হোসাইন। বিভিন্ন সেশনে ‘ইসলামী পারিবারিক শিক্ষা ও পরিবার গঠনে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য’ নিয়ে আলোচনা করেন ব্যারিস্টার হামিদ হোসাইন আজাদ ও ড. আবুল কালাম আজাদ বাশার। প্রথম দিনে বিভিন্ন বিষয়ে মোট ১১টি সেশনে ইসলামের বিশ্বব্যাপী প্রসার থেকে শিক্ষা, বিশ্বজুড়ে দ্বীনের আলো ছড়ানো পথপ্রদর্শকরা, আলো ছড়িয়ে দিন, ঐক্য গড়ে তুলুন, সহনশীল মুসলিম যুবক, সিস্টার অনলি এন্টারটেইনমেন্ট সেশন, সংঘাতের ছায়া : মার্কিন ন্যায়বিচারের উপর কাশ্মীরের প্রতিফলন, সংগ্রামের প্রতিধ্বনি : আমেরিকান বিচারে কাশ্মীরের সমান্তরালতা প্রভৃতি বিষয়ে সেমিনার। সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের ইসলামিক ১০টি সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ অংশ নেন বলে মুনা’র ন্যাশনাল মিডিয়া ডিরেক্টর আনিসুর রহমান গাজী জানান।
কনভেনশনের দ্বিতীয় দিনে বিভিন্ন বিষয়ে ২৮টি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এদিনের কনভেনশনে আলোচিত সেশনের মধ্যে ছিল- ইসলামী মূল্যবোধের উন্নয়নে সম্প্রদায়ের ভূমিকা, আমলের পূর্ণতার জন্য বিশুদ্ধ নিয়ত অপরিহার্য, ইসলামের বিশ্বব্যাপী প্রসারে বাংলা অধিবেশন- পরিবর্তন চাই? শুরু হোক আমার থেকেই! প্রাথমিক মুসলিমদের অবদান, ইয়ুথ বয় প্রোগ্রামের মধ্য ইসলামের মাধ্যমে হৃদয়কে সংযুক্ত করা, নৈতিক রূপান্তরের পথিকৃৎ মুসলিমরা, শক্তিশালী সম্পর্ক নির্মাণ। ইয়ুথ সিস্টার সেশনগুলোর মধ্য আলোকিত পথ বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে, একজন মুসলিমের আধ্যাত্মিক যাত্রা, মুসলিম নারী নেত্রীদের আত্মবিশ্বাস ও করুণার সাথে নেতৃত্ব দেওয়া, যেকোনো জায়গায় অন্যায়, সর্বত্র ন্যায়বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপ। প্যারালাল সেশনের মধ্য ছিল- আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ ইন্টিগ্রেটেড থট-টুওয়ার্ডস হোলিস্টিক ডেভেলপমেন্ট (এআইআইটি) এর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠন, যত্ন এবং ঐক্যের মাধ্যমে সংকটের প্রতিক্রিয়া জানানো এবং ‘ত্রাণ প্রচেষ্টা কীভাবে জীবনকে বদলে দেয়’ নিয়ে সেমিনার করে জাকাত ফাউন্ডেশন।
এর মধ্যে ইয়ুথ সেশনে ইসলামী জীবন যাপনের উপর আলোচনা করেন তরুণ ইসলামিক স্কলার ক্যাথলিক (খ্রিষ্টান ধর্ম) পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আমেরিকান বংশোদ্ভূত বর্তমানে মুসলিম ধর্ম গ্রহণকারী ইমাম টম ফ্যাসিন।
এদিন রাতে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন বিশেষ করে মুনা শিল্পী গোষ্ঠী ও শিশুদের ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশনের পাশাপাশি স্ট্যান্ড আপ কমেডি ও কবিতা আবৃত্তি সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের ঘটনা প্রবাহ ফুটে ওঠে। উঠে আসে আয়না ঘরের ভয়াবহ চিত্র। যা দর্শক শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে।
কনভেনশনের শেষ দিনে সকালে সাংবাদিকের সাথে মতবিনিময় করেন মুনা’র ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমাম দেলোয়ার হোসাইন এবং মুনা’র ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর আরমান চৌধুরী। মুনা’র অন্যান্য কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট হারুন অর রশীদ সহ আবু আহমদ নূরুজ্জামান, এসিস্টেন্ট এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টও আব্দুল্লাহ আল আরিফ, ন্যাশনাল শুরা সদস্য মোশারফ মাওলা সুজন, আশরাফ আকবর, নিউইয়র্ক নর্থ জোনের সেক্রেটারী মমিনুল ইসলাম মজুমদার, নিউইয়র্ক সাউথ জোন মিডিয়া পরিচালক আমিনুর রসুল জামশেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এসময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন মুনা’র ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমাম দেলোয়ার হোসাইন।
ইমাম দেলোয়ার হোসাইন বলেন, আমেরিকায় বেড়ে উঠা আমাদের নতুন প্রজন্ম নিয়ে চিন্তিত। বিভিন্ন অপরাধের সাথে নতুন প্রজন্ম থেকে শুরু করে অনেক বাংলাদেশী সম্পৃক্তার ঘটনা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। প্রশাসনের অনেকেই এসব নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করেন। তাই বিষয়টি সবার গুরুত্বদিয়ে ভাবতে হবে। আগামীতে পেনসিলভেনিয়ার বাইরে অন্য কোন সুবিধাজনক স্থানে কনভেনশন করার বিষয়টি দেখা হবে বলেও জানান তিনি।
এ দিনের প্রধান অধিবেশনে বিশ্বাসের তরঙ্গায়িত প্রভাব : বিভিন্ন সমাজে ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, বহুসংস্কৃতির সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামের রূপান্তরকারী শক্তি, ঐক্যের ঝলকে সংস্কৃতি জুড়ে ইসলামী শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়া সহ বিভিন্ন সেশনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এদিকে বেলা ১১টা থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন আলোচনার পাশাপাশি মুনা শিশুদের পুরস্কার বিতরণী ও অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ইমাম দেলোয়ার হোসাইন ও আরমান চৌধুরী সহ মুনার নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিশুদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। এদিন ড. আতাউল ওসমানীর নেতৃত্বে মুনা’র সাংস্কৃতিক দল মনোজ্ঞ ইসলামিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন।
বিভিন্ন সেশনে বক্তব্যকালে মুনার সাবেক প্রেসিডেন্ট হারুন উর রশিদ বলেন, যারা ইসলামের জন্য জীবন দিতে রাজি আল্লাহ তাদের হাতেই বিজয় দিবেন। জিহাদ ছাড়া আল্লাহ বিজয় দান করবেন না। প্রযুক্তি আজ আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেটের হাত থেকে তাদের বাচতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইমানদারদের বিজয় দান করবেন।
ইমাম সিরাজ ওয়াহাজ বলেন, প্রতিটি মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। কেউ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে না। আমাদের সম্পদ ইসলাম প্রচারে ব্যয় করতে হবে।
শেখ মিখাইল আহমেদ বলেন, আমাদের প্রজম্ম আজ ইসলামকে বুঝতে পারছে না। এটি আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের সব সময় আল্লাহর জিকিরে থাকতে হবে। আমাদের হালাল - হারাম মেনে চলতে হবে। সাহাবারা আল্লাহর বিধান মানার কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন।
শেখ মোহাম্মদ বেলাল বলেন, ব্যবসা বাণিজ্য সব কিছুতেই ইসলাম থাকতে হবে। আমাদের মানবিক সকল গুণাবলী অর্জন করতে হবে। এজন্য আমাদের অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। সততার গুণাবলী অর্জন করতে হবে। তাহলে অমুসলিমরা আকৃষ্ট হবে। মসজিদের সাথে আমাদের সম্পর্ক বাড়াতে হবে। ইউরোপ আমেরিকায় ইসলাম প্রচার করতে হলে ইংরেজি জানতে হবে, গুগল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ইংরেজি জানা সন্তানদের ইসলাম শিক্ষা দিতে হবে।
হামিদ হোসাইন আজাদ বলেন, আল্লাহ মানুষকে পরিক্ষা করেন। পুরো জীবনই হলো পরিক্ষা। দুনিয়ার জীবনকে কাজে লাগাতে হবে। পরিক্ষা ছাড়া আল্লাহ মানুষকে জান্নাত দিবেন না। এটি তাকে অর্জন করতে হবে। সফলতা অর্জন করতে হলে পরিক্ষায় ভালো করতে হবে। তাহলেই জান্নাত পাওয়া যাবে।
ড. আবুল কালাম আজাদ বাশার নিজেকে এবং পরিবারকে বাচানো এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, মানুষ খুবই দুর্বল, সে জম্মের পর হাটতে পারে না, নিজের হাতে খেতে পারে না। ভালো মন্দ জ্ঞান তার থাকে না। তারপরেও সে অহংকার করে। মানুষকে আল্লাহর রঙে রঙ্গিন হতে হবে। আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলতে হবে। শুধু ইবাদত করলে চলবে না, তার জমিনে তার দ্বিন প্রতিষ্টা করতে হবে। নিজের পরিবারকে যদি ইসলামের অনুস্মরণ না করানো যায় তাহলে হাশরে তার সন্তানরা মামলা করবে। নিজেকে অর্থ কামানোর মেশিন বানানো যাবে না। মনে রাখতে হবে দ্বিনের দাওয়াত ছাড়া অমুসলিম দেশে থাকা জায়েজ নেই। তাই দ্বিনের প্রচার করতে হবে।
ড. আলতাফ হোসেন বলেন, উত্তর চরিত্র এবং ভালো ব্যবহার দিয়েই মানুষের মন জয় করতে হবে, নতুন প্রজম্মকে আকৃষ্ট করতে হবে। ওয়াদা রক্ষা করতে হবে। যে দেশেরই হই না কেন আমাদের পরিচয় মুসলিম।
মুনার প্রেসিডেন্ট ইমাম দেলোয়ার হোসাইন বলেন, ইসলাম প্রচার করতে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। ইসলামকে সহজ করতে হবে। কঠিন করা যাবে না। মুনা আমেরিকার প্রতি ঘরে ঘরে দাওয়াত পৌঁছাতে চায়।
বিশাল এ কনভেনশন বাস্তবায়নের ৭ সদস্য বিশিস্ট নীতি নির্ধারণ কমিটি ছাড়াও ২১টি সাব কমিটি করা হয়। মূল কমিটির সদস্যরা হলেন- আরমান চৌধুরী, জিয়াউল ইসলাম শামীম, আব্দুল্লাহ আল আরিফ, ড. প্রফেসর রুহুল আমিন, আহমেদ খালেদ হোসাইন, মোহাম্মদ নূরুল আনোয়ার।