বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
ভোটের আগে অনেক চ্যালেঞ্জ
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ১২:১২ এএম, ১৬ আগস্ট ২০২৫ শনিবার

বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। অনিশ্চয়তা অনেকটা কেটে গেছে। নির্বাচন কমিশন আগামী সপ্তাহে রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। তখন ভোটের বিষয়ে একটা আমেজ সৃষ্টি হবে। কিন্তু ভোটের আগে রয়ে গেছে অনেক প্রশ্ন। জুলাই সনদ প্রণয়নে দলগুলো একমত হওয়া দূরের কথা কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি। তার বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সে বিষয়েও কোনও মতৈক্য হয়নি। নির্বাচনে বাংলাদেশের বড় দল আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে কিনা। আওয়ামী লীগ না থাকলে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা। এসব প্রশ্ন আছে। কেউ কেউ বলেন, বিগত তিনটি নির্বাচনে দিনের ভোট আগের রাতে হয়ে গেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ভোটের মাঠে না থাকলে ভোটের আগেই বিজয় মিছিল বের হবে। তখন এই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করা যাবে না।
আওয়ামী লীগের কর্মকান্ড বর্তমানে নিষিদ্ধ আছে। ফলে নির্বাচন কমিশনও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিএনপি ও জামায়াত একত্রে রাজপথে ছিলো। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নেতারা নতুন দল এনসিপি গঠন করলেও এই দলের কেউ নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে এমন কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলে সেখানে কোনও ভারসাম্য থাকবে না। সার্বিক বিষয় চিন্তা করলে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি একই ধাঁচের রাজনৈতিক দল। ফলে এগুলো মিলে নতুন পার্লামেন্ট তৈরী হলে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকবে না। জামায়াতে ইসলামী বিরোধী দল হিসাবে যুৎসই হবে না।
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অর্ন্তবর্তি সরকার এক বছর পূর্ণ করার সময়ে নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা আছে। গত ৫ই আগস্ট ইউনূস অভ্যূত্থানের এক বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে ‘জুলাই ঘোষণা’ পাঠ করেন। শেখ হাসিনাকে সরানোর আন্দোলন ২০২৪ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাই এই অভ্যূত্থানকে ‘জুলাই বিপ্লব’ বলেও অভিহিত করা হয়। জুলাই ঘোষণার মূল কথা হলো, জুলাইয়ের আন্দোলনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া। ইউনূস যে জুলাই ঘোষণা দিয়েছেন সে বিষয়ে মোটামুটি মতৈক্য হয়েছে। জুলাই সনদ অনেক বেশি বিস্তৃত। যে সব সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে সেগুলোর মিলিত বাস্তবায়ন জুলাই সনদ।
জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি মনে করে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন করার পর নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি এই বিষয়ে একমত হয়নি। বিএনপি মনে করে, জুলাই সনদের সিংহভাগ বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন। সংবিধান সংশোধন করার জন্য সংসদ প্রয়োজন। এসব কারণে বলা হয়েছিলো যে, জুলাই সনদ নির্বাচিত সরকার প্রথম দুই বছরে তা বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু এনসিপি এখন সোচ্চার ভোটের আগেই জুলাইন সনদ বাস্তবায়ন দাবি নিয়ে। এমন এক টানাপোড়েনের মধ্যে মূলত যেসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব সেগুলো ভোটের আগেই বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অবশিষ্ট প্রস্তাব ভোটের পরে বাস্তবায়ন হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের করা সম্ভব না হলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে দেবে না এমন কথা কেউ কেউ বলে থাকেন। এখন জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচন বর্জন করলে কী হবে ? উত্তর সবার জানা। ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচন পরিচালনায় সুদক্ষ নয়। এমন ঘটনা ঘটলে বিকল্প হিসাবে ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। যদিও সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণে মোটেও আগ্রহী নয়। এমন ক্ষেত্রে ইউনূসের পরিবর্তে অন্য কোনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে তার মাধ্যমে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এসব বাস্তবতা চিন্তা করে বর্তমানে মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে একমত হবে বলে স্পষ্ট ধারণা করা যায়।
শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই জুল্ইা আন্দোলনকালে মানুষের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশদাতা হিসাবে অভিযুক্ত। তাছাড়া, বিগত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে একতরফা নির্বাচন করে গণতন্ত্রেও ভিত্তি দুর্বল করেছে। এসব অপরাধের কারণে শেখ হাসিনাসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, দুর্নীতি এবং অন্যান্য অপরাধের বিচার চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে মোট ভোটারের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া না হলে এই ২০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্র খোঁজে পাবেন না। এই কারণে প্রথমে রিফাইনড আওয়ামী লীগের নামে দলটির কিছু নেতাকে নিয়ে ভোটে অংশ নেবার আলোচনা ছিলো। কিন্তু বিষয়টি এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ফাঁস করে দেন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী তাদেরকে ডেকে নিয়ে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ করার বিষয়ে সম্মতি চেয়েছিলো।
ডরফাইন্ড আওয়ামী লীগ গঠন করা এখন আর সম্ভব নয়। তাই অন্য কোনও উপায়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে আওয়ামী লীগকে ভোটের মাঠে রাখা যায় কিনা এই আলোচনা চলছে। সম্প্রতি গণতন্ত্র মঞ্চ নামের একটি ছোট জোট ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে বলে ঘোষণা করে। আ স ম আব্দুর রবের জাসদ, মাহমুদুর রহমান মান্নার জাতীয় ঐক্য, সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জোনায়েদ সাকীর গণসংহতি আন্দোলনের মতো ছোট ছোট দল মিলে গণতন্ত্র মঞ্চ গঠিত। এদের সকল অর্থাৎ ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবার মতো উপযুক্ত প্রার্থী নেই। ফলে জোটটি আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী ধার নেবে কিনা সেটিই দেখার বিষয়।
নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পূর্ব শর্ত হলো শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে বেশি নাজুক। পুলিশ বাহিনীর ভঙ্গুর দশ। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ আশু প্রয়োজন।