এলডিসি উত্তরণের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৪৩ এএম, ১৫ আগস্ট ২০২৫ শুক্রবার

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। অতীতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বাহবা নিতে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই পথে চললে তা দেশের অর্থনীতি জন্য হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাই উত্তরণের সময় ৩-৫ বছর পেছানো উচিত।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানী শেরাটন হোটেলে এক সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা সরকারকে এ পরামর্শ দিয়েছেন। ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ : বাংলাদেশের সামনে বিকল্প’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশ (আইসিসি-বি)। আইসিসি-বি সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্কের জ্যেষ্ঠ গবেষক সানিয়া রিয়াদ স্মিথ।
মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি আব্দুল মোক্তাদির, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের চেয়ারম্যান আবদুল হাই সিকদার, সিডিপির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান ও পিআরআই-এর চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার।
মূল প্রবন্ধে সানিয়া স্মিথ বলেন, এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপানে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা হারাবে। ২০১৮ সালের হিসাবে রপ্তানি হারাবে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। পেটেন্টের কারণে ওষুধের দাম বাড়তে পারে। উত্তরণের তালিকায় থাকা অনেক দেশ এলডিসির ফাঁদ এড়াতে পরবর্তী সময়ে আগায়নি, সক্ষমতা অর্জনের পরও পিছু হটেছে। অ্যাঙ্গোলার মতো দেশ গ্র্যাজুয়েশনের এক সপ্তাহ আগে প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছে। মিয়ানমারের ২০২৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন হওয়ার কথা থাকলেও তারা আগ্রহ দেখায়নি।
আবদুল মুক্তাদির জানান, পেটেন্ট বাধ্যবাধকতা না থাকায় বর্তমানে অনেক দুর্মূল্য ওষুধ কম দামে পাওয়া যায়। এলডিসি উত্তরণের পর হেপাটাইটিস সির ওষুধের ৬-৭ ডলার থেকে বেড়ে হাজার ডলার ছাড়াবে। এলডিসি উত্তরণের কোনো কোনো ওষুধে কী প্রভাব পড়বে, দাম কেমন হবে, পেটেন্ট পাওয়া কতটা কঠিন হবে- সে সম্পর্কে সবাই অবগত। কিন্তু সরকারকে এ বিষয়ে বারবার বলার পরও আগ্রহ দেখাচ্ছে না তারা।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই এলডিসি উত্তরণ করতে হবে, তবে এখনই উপযুক্ত সময় নয়। এজন্য আরও সময় নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার দরকার আছে। এমনিতেই শিল্পের জ্বালানি খাতের করুণ দশা, ব্যাংকের উচ্চ সুদ, কাস্টমসে জটিলতা বিদ্যমান। তার ওপর এলডিসি থেকে বেরিয়ে এলে ইউরোপের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এ অভিঘাত তৈরি পোশাকশিল্প সহ্য করতে পারবে না।
লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘৬ বছরের আগে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী হবে। ২০২৬ সালের নভেম্বরে কোনোভাবেই বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে যাওয়া উচিত হবে না।
মঞ্জুর জানান, ২০১৯ সালে কোভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে অর্থনীতি একের পর এক ‘শক’-এর মধ্য দিয়ে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের কারণে দেশি-বিদেশিদের আস্থায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। শুধু জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে ব্যবসার ব্যয় সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ৮৫ শতাংশ অবদান বেসরকারি খাতের। কিন্তু বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনা না করে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে কেন? আগামী ৩ বছরে দেশে কি স্বর্ণ বা হীরার খনি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যে রাতারাতি সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে। মালদ্বীপ ও গিনি এলডিসি উত্তরণের ফাঁদে পড়েছে। অবশ্যই এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসতে ৩-৬ বছর সময় নেওয়া উচিত।
ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে সায় দিয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সরকার, আমলা এবং ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে একটি সিদ্ধান্তে দ্রুত আসা উচিত। বাংলাদেশের সঙ্গে আগামী বছর নেপালও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে যাবে, তাদের সঙ্গেও সমন্বয় জরুরি।
‘ব্যাংকিং খাত বাদে দেশের অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার আসেনি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ হলেও অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি কেউ আমলে নেয়নি। শ্বেতপত্র কমিটির বেশির ভাগ সুপারিশই গ্রহণ করা হয়নি। এ অবস্থায় সংস্কার ছাড়া এলডিসিতে গেলে দেশের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ও বিনিয়োগ বিপদের মুখে পড়বে,’ শঙ্কা প্রকাশ করেন সেলিম।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এলডিসির জন্য বাংলাদেশ যতটা না অর্থনৈতিক বিবেচনায় এগিয়েছে, তার থেকেও এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ ছিল বড়। বিগত সময়ের রাজনৈতিক সাফল্য দেখাতে সক্ষমতা ও প্রস্তুতি ছাড়াই এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ভালো ফল বয়ে আনবে না।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘উপদেষ্টাদের অর্ধেকই ইন্টার্নশিপ করতে এসেছেন বলে মনে হচ্ছে।’ তাদের কিন্তু এখানে কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা নেই। বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ থাকলেও বিদেশ থেকে এনে অনেককে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘এদেশের বিশেষজ্ঞরা কি ঘাস খায়? আমাদের দেশে তো এত এক্সপার্ট আছেন।’ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে কাজ করতে দেশের বাইরে থেকে একজন উপদেষ্টা আনা হয়েছে। সরকারে এমন কাউকে কেন লাগবে, যার শিকড়ই এই দেশে নেই। দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে যাদের অনুভব নেই।’ তিনি বলেন, ‘যারা কাজ করার মধ্য দিয়ে শিখতে চান, এমন ব্যক্তি আমাদের প্রয়োজন নেই। জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকেই তাদের বেতন দিতে হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’
এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, বর্তমান সরকার ভঙ্গুর অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির জায়গা থেকে একটু ভালো জায়গায় নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এককথায় এলডিসি উত্তরণের সিদ্ধাস্ত হবে আত্মঘাতী। কারণ, আমরা এখনো ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে বের হতে পারিনি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফশসল করতে ১ হাজার ২০০ আবেদন জমা পড়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৪০ শতাংশ। গ্যাসের অপর্যাপ্ততা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ শিল্পের সক্ষমতা কমিয়ে ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার তো দেশের স্বার্থেই এলডিসি উত্তরণ চায়। আমরাই তো মনে করছি যে এটা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। তাহলে এ ব্যাপারে সরকারকে আর আগানো উচিত হবে না।