পুরো গাজা দখলের পাঁয়তারা
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:০৮ এএম, ৭ আগস্ট ২০২৫ বৃহস্পতিবার

এখানে লোকজন বাস্তুচ্যুত। সবাই বসবাস করছে তাঁবুতে। কিন্তু সেখানেও বোমা ফেলছে ইসরায়েল। তাই গাজায় কোনো নিরাপদ স্থান নেই। আমরা শিশুদের দেখছি– কারও গোড়ালি নেই, কারও হাত কিংবা পা। আহতদের অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হয় না।
গাজায় সেবা দেওয়া ব্রিটিশ চিকিৎসক ভিক্টরিয়া রোজ আলজাজিরার সঙ্গে আলাপকালে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের ত্রাণ সরবরাহ কেন্দ্রে খাদ্য আনতে গিয়ে গুলিতে নিহত হয়েছে এক যুবক। তাকে বিছানার চাদরের মধ্যে রেখে চার কোণে ধরে স্বজনদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে কয়েক কিশোর। এমন দৃশ্য এখন নিত্যদিনের।
এসবের পাশাপাশি আছে অনাহার-দুর্ভিক্ষে মৃত্যু। গাজায় কার্যত গণহত্যা চালানোর ক্ষেত্রে বোমা, ত্রাণকেন্দ্রে গুলি ও অভুক্ত রাখার নির্মম পদ্ধতি বেশি ব্যবহার করছে ইসরায়েল। এ তিনভাবে নিহত প্রায় সবাই বেসামরিক মানুষ। গতকাল মঙ্গলবার আলজাজিরা জানায়, গাজায় স্থল অভিযান জোরদার করছে ইসরায়েল। তবে বিমান হামলা বেড়েছে। সেই সঙ্গে উপত্যকার বিভিন্ন অংশে নতুন করে প্রবেশ করছে সশস্ত্র সামরিক যান।
এ অবস্থায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পুরো গাজা দখলের পরিকল্পনা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। এতে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী পুরো উপত্যকায় অভিযান সম্প্রসারণ করবে। এর মধ্যে ইসরায়েলের বন্দিদের জিম্মি রাখার হামাসের এলাকাগুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ইসরায়েলের চ্যানেল ১২-এর প্রধান রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমিত সেগা বলেন, ইতোমধ্যে ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে’। ইসরায়েলের আই২৪ নিউজ, দ্য জেরুজালেম পোস্ট, ওয়াইনেট এ খবর জানিয়েছে।
অমিত সেগা বলেন, ‘সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ না করলে হামাস আর কোনো জিম্মি মুক্তি দেবে না। আমরাও আত্মসমর্পণ (হামলা বন্ধ) করব না। যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ না নিই, তাহলে জিম্মিরা অনাহারে মারা যাবে এবং গাজা হামাসের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’ আলজাজিরা জানায়, ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ পদক্ষেপের ‘বাস্তবায়ন ঠেকাতে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে।’ এ পরিকল্পনা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
অপুষ্টি ও ইসরায়েলের হামলার কারণে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর মধ্যে মানবিক সহায়তায় বাধা না দিতে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়ছে। যুদ্ধ বন্ধে নিজ দেশের ভেতরেও রয়েছে চাপ। বিভিন্ন দেশে হামলা বন্ধ ও ত্রাণ সরবরাহের দাবিতে চলছে বিক্ষোভ। কিন্তু কিছুই আমলে নিচ্ছেন না নেতানিয়াহু।
হামাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওসামা হামদান গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোকে ইসরায়েলের নৃশংসতার প্রতি অন্ধ থাকার অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, নেতানিয়াহুর সরকার জিম্মিদের জীবনের জন্য দায়ী থাকবে। তার একগুঁয়েমি, অহংকার, যুদ্ধবিরতি চুক্তি এড়িয়ে যাওয়া, আমাদের জাতিগত নির্মূলের চেষ্টা ও
অনাহারে রেখে হত্যার কারণে পরিস্থিতি এমন মোড় নিচ্ছে।
৫২ ত্রাণপ্রত্যাশীসহ এক দিনে আরও ৮৭ জন নিহত
গাজায় হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে ইসরায়েল। গতকাল মঙ্গলবার এক দিনে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৫২ জন ত্রাণপ্রত্যাশীসহ ৮৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। মিউল ইস্ট আই জানায়, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৬১ হাজার ২০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৫০ হাজার ৬৭১ জন। নিহতদের মধ্যে ১৮ হাজার ৪৩০ শিশু রয়েছে।
ক্ষুধায় মৃত্যু বাড়ছে
গাজায় প্রতিদিনই অনাহারে মৃত্যু বাড়ছে। গতকাল মঙ্গলবার এক দিনে আরও আটজন মারা গেছেন। এদের মধ্যে একটি শিশুও রয়েছে। এ পর্যন্ত ক্ষুধায় ৯৪ শিশুসহ ১৮৮ জন মারা গেলেন। এদিন গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও আট লাশ উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হয়, অন্তত ১০ হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।
ত্রাণকেন্দ্রে যাওয়ার সামর্থ্য নেই অধিকাংশের
গাজার অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষ অনাহারে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, তারা ত্রাণকেন্দ্রে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে না। গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিল (ডিআরসি) জানিয়েছে, অধিকাংশ মানুষই শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। দূরের পথ হেঁটে ত্রাণকেন্দ্রে যাওয়ার শক্তি তাদের নেই। উত্তর গাজা, গাজা সিটি, খান ইউনিস ও দায়ের আল বালাহ এলাকায় জরিপের ভিত্তিতে ডিআরসি এ তথ্য জানিয়েছে।
গাজায় শৈশব নেই
গাজায় এ পর্যন্ত ১৮ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। গড়ে প্রতি ঘণ্টায় মারা যাচ্ছে এক শিশু। যারা বেঁচে আছে, তাদের কাছে শৈশব মানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগাড় করার লড়াই। বোমা হামায় পুড়ে গিয়েছিল ১০ বছরের লায়লা। তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ ধবল হয়ে গেছে। সে আলজাজিরাকে জানায়, ‘আশা করি আমার চিকিৎসা হবে। আমাকে আবার সুন্দর দেখাবে। আমি চাই শরীরের শাদা দাগগুলো চলে যাক।’