বুধবার   ০৬ আগস্ট ২০২৫   শ্রাবণ ২২ ১৪৩২   ১১ সফর ১৪৪৭

মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল বলেই অভ্যুত্থান সফল হয়েছে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৬ পিএম, ৫ আগস্ট ২০২৫ মঙ্গলবার

জাকিয়া বারী মম

 

শুরুতে জানতাম না, এ আন্দোলন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ছাত্রদের সাহস আমাকেও সাহসী করেছে। দেশের মানুষের পাশে থাকার শক্তি দিয়েছে। নিজের মতো করে কথা বলার সাহস দিয়েছে। এমনকি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণাও দিয়েছে এই আন্দোলন। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল বলেই এ অভ্যুত্থান সফল হয়েছে।

 

আমার নানা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, তখন মা স্কুলে পড়তেন। তাই আমি যখন রাজপথে নেমেছি, পরিবার থেকে কোনো বাধা পাইনি, বরং সহযোগিতা পেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, সুবিধা না নিলে সুবিধা দিতে হয় না। নিজের মতো করে, নিজের আদর্শ মেনে কাজ করেছি। আমার কাছে এই আন্দোলন সঠিক মনে হয়েছে বলেই যোগ দিয়েছি। এ পরিবর্তন হওয়ারই ছিল। দুর্নীতি প্রতিটি সেক্টরে ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া হচ্ছিল। মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছিল। কথা বলার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছিল।

 

নবীন প্রজন্মের সাহসকে আমি লাল সালাম জানাই। আমার ছেলে আমাকে বলেছিল, ‘মা, তুমি কেন আমাদের সঙ্গে থাকবে না?’ যারা এতদিন কথা বলতে পারেনি, তাদের এই প্রজন্ম কথা বলতে শিখিয়েছে। আন্দোলনের দিনগুলোতে দেখেছি, ট্রাফিক মেনে সবাই লাইন ধরে চলছে, অটোচালক ভাড়া কম নিচ্ছেন, কারণ চাঁদা দিতে হয়নি। তখন যদি সম্ভব হয়, অন্য সময় কেন হয় না? আমরা সরকারকে ট্যাক্স দিই, তারা আমাদের দাস ভাবতে পারে না। আমি চাই না, ভবিষ্যতে এমন অবস্থা দেখতে হোক।

সন্তানের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই রাজপথে নেমেছিলাম। জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল আমাদের প্রজন্মের আত্মচেতনার জাগরণ। এটি শুধু সরকার পতনের আন্দোলন নয়, ছিল তরুণ-তরুণীর বিবেকের ডাকে সাড়া দেওয়ার ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমি একে দেখি নবজাগরণ হিসেবে, যেখানে সত্য, সাহস ও স্বপ্ন মিলে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল শিক্ষার্থীরা। আমরা চেয়েছিলাম নিম্ন শ্রেণি থেকে উচ্চ শ্রেণি সবাই সমানভাবে বাঁচুক।

 

যদিও স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি; লড়াই ছিল সেই বিশ্বাসে। আমরা জানি, সংস্কৃতি অঙ্গন কতটা খুঁড়িয়ে চলছিল। আশা করেছিলাম, বিটিভি, বিএফডিসি ও বিভিন্ন সংগঠন দলীয়করণের বাইরে এসে সঠিক কাজ করবে। পুরস্কার প্রদানে স্বচ্ছতা আসবে। নির্মাতারা স্বাধীনভাবে গল্প বলতে পারবেন। কথা বলার ওপর কোনো চাপ থাকবে না।

আমি গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। ভিউ-কালচার আমাকে বিরক্ত করে। সঠিক মানুষকে তুলে ধরতে হবে ব্যক্তিস্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থে। কিন্তু অভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও এসব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জানি না, কবে হবে! বিষয়টি হচ্ছে, ক্ষমতা যে-ই যায়, সে-ই পরিবর্তন হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের হয়ে উঠতে চায় না কেউ। আমি মনে করি, যেদিন থেকে এ দেশে শিক্ষকের সম্মানের চেয়ে লোভী রাজনীতিবিদের সম্মান বেড়েছে, সেদিন থেকেই আজকের পরিণতি শুরু।

 

বহু আগে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলে, ‘যে দেশে গুণীর সম্মান নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না।’ আমরা তার মর্ম বুঝিনি, এখনও বুঝি না। এভাবে চলতে থাকলে মৃত্যুর পর নয়, বেঁচে থাকতেই পুঁজগলা, দুর্গন্ধযুক্ত নরক দেখতে হবে। এ দায় অতীত থেকে বর্তমান কোনো রাজনীতিবিদ এড়াতে পারবেন না। প্রকৃতি তাদের জন্য চরম শাস্তি বরাদ্দ রাখবে। শেষ কথা–আমি শিল্পী; ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায় বলব। শিল্পী তার অবস্থানে থাকবে। কে কীভাবে বেছে নেবে, সেটা তার ব্যাপার। তবে আমি মনে করি, একজন শিল্পীর কাছে শিল্পের গুরুত্বই সর্বাধিক হওয়া উচিত।