শোকে মুহ্যমান বাংলাদেশ
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:১৩ এএম, ২৬ জুলাই ২০২৫ শনিবার

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: বাড়ছে লাশের মিছিল
দুঃস্বপ্ন এখনও ভুলতে পারছে না বাংলাদেশ। গোটা জাতি হত-বিহ্বল। এর মধ্যে ৩১টি প্রাণ চলে গেছে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিভু নিভু প্রদীপের মতো জ¦লছে যেসব প্রাণ; তাদেরও বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। জাতীয় বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সষ্টিটিউটে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ প্রায় অর্ধশত পোড়া রোগীর মধ্যে অন্তত ২৫ জনের অবস্থা গুরুতর। দেশের চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। সিঙ্গাপুর, ভারত, চীন থেকেও চিকিৎসক ও নার্স এসেছেন। সবচেষ্টা ব্যর্থ করে না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। বেড়েই চলেছে লাশের মিছিল। একেকজন মায়ের বুক খালি হচ্ছে। স্বজনের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হচ্ছে। থেমে যাচ্ছে জীবনের গল্প।
ক্যানভাসটা একেবারেই অকল্পনীয় ছিলো। মর্শিয়া সাহিত্যে এমন ক্রন্দন কেউ দেখেনি। সেই অশ্রুসিক্ত বেদনার কাব্য বাস্তবে দেখলো বাংলাদেশ। জঙ্গি বিমান আছড়ে পড়েছে শিশুর ক্লাসে। আগুন থেকে শিশুদের উদ্ধারে ঝাপিয়ে পড়েছেন শিক্ষিকা মাহরিন। ২০ শিশুকে বাঁচিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন নিজে। শ্বাসরুদ্ধকর। হিম হয়ে আসে শরীর। শিশুরা পুড়ছে। গলে গলে যাচ্ছে লাশ। আইডি কার্ড ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। ডিএনএ টেস্ট করে নাশ শনান্ত হচ্ছে। লাশ নয় যেন, পুড়ে অঙ্গার হওয়া টুকরো টুকরো পিন্ড। এমন দৃশ্য কখনও কল্পনা করেনি বাংলাদেশ। এমন ঘটনা সিনেমা কিংবা নাটকে কিংবা কল্পিত চরিত্রে দেখা গেলেও বাস্তবে তা ভাবা যায় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য এমন ঘটনাই প্রত্যেক্ষ করলো বাংলাদেশ। দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে এখন পর্যন্ত মৃতের তালিকায় আছে ৩২ জন।
প্রতিবেশি ভারতসহ অনেক দেশই আহতদের নিয়ে চিকিৎসা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সষ্টিটিউটের পরিচালক ডা. নাসির উদ্দিন বলেছেন, চিকিৎসাধীন রোগীদের বিদেশে নেবার কোনও অবস্থা নেই। ফলে সর্বোচ্চ চিকিৎসার দাবিটা জোরালো হচ্ছে। মাইলস্টোনের ছেলে-মেয়েরা এতটাই আচ্ছন্ন যে, মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বলে সন্দেহে দুই উপদেষ্টা দশ ঘন্টা অবরুদ্ধ ছিলেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারকে ছাড়াতে শেষ পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বল প্রয়োগ করতে হয়েছে।
আইএসপিআর বলছে, বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমানটি প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার হচ্ছিল। হঠাৎ যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। পাইলট ফ্লাইট ল্যাফটেন্যান্ট তৌকির বিমানটিকে খোলা জায়গায় অবতরণের লক্ষ্যে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করেছেন। এটি দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়ে। তারপর বিমানটি ধ্বংস হয়। আগুন জ¦লে যায়। স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ায় দুই শতাংশ ছাত্রও ছিলো না। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, একদম শিশু বাচ্চারা এই ঘটনায় নিহত হয়েছে বেশি। ভবনটি কম উঁচু এবং শক্তিশালী হওয়ায় ভেঙ্গে পড়েনি।
এরই মধ্যে ঘটে গেছে অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা। মাহরিন নামের এক শিক্ষক প্রায় ২০ জন শিশুকে প্রাণে বাঁচিয়ে নিজেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। গৃহবধূ লামিয়া আখতার সোনিয়া। তার মেয়ে জায়রা পড়তো রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণিতে। প্রতিদিনের ন্যায় গত ২১ জুলাই স্কুলে যায় জায়রা। আর মা লামিয়া যায় মেয়েকে আনতে। এরই মধ্যে ঘটে বিপত্তি। মাইলস্টোনের স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয় প্রশক্ষিণ বিমান। আর এতেই গুরুতর দগ্ধ হন মা লামিয়া। মেয়ে জায়রা প্রাণে বাঁচতে পারলেও মৃত্যুর কোলে পড়েন এ মা। মৃত্যুর চারদিন পর বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সন্ধ্যায় ডিএনএর মাধ্যমে শনাক্ত হয়েছে লাশের পরিচয়।
নিহত লামিয়া সাভার উপজেলার বাগ্নিবাড়ি এলাকার সাবেক ওয়ার্ড ইউপি সদস্য বাবুল হোসেনের মেয়ে ও উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম জনির স্ত্রী।
লামিয়ার লাশ শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে নিহতের ভাই মোহাম্মদ মুসা। তিনি বলেন, বাবার দেওয়া ডিএনএ স্যাম্পলের সঙ্গে মর্গে থাকা একটি লাশের মিল খাই। পরে আমাদের বিষয়টি জানানো হয়। আমরা লাশ নিতে পরিবারসহ হাসপাতালে যাচ্ছি।
এদিকে, লামিয়ার মৃত্যুর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়ে পরিবারের সদস্যরা। শত শত মানুষ ভিড় করে লামিয়ার বাবার বাড়িতে।
ভাগ্নি জায়রার বরাতে মুসা বলেন, ‘ঘটনার কয়েক সেকেন্ড আগে জায়রাকে ব্যাগ নিয়ে নীচে আসতে বলে লামিয়া। এরপরই বিমান বিধ্বস্ত হয়। আগুনে দগ্ধ হয় লামিয়া। পরে সেনাবাহিনী ভাগ্নিকে তার সহপাঠীদের সঙ্গে উদ্ধার করলেও আমার বোনকে পাওয়া যাচ্ছিল না। গত ৪ দিন ধরে বিভিন্ন হাসপাতাল ও মর্গে খোঁজাখুঁজি করেও তার হদিস পায়নি।
নিহতের বাবা বাবুল হোসেন বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, আমার মেয়েকে উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম জনির কাছে বিয়ে দিয়েছিলাম। তাদের একমাত্র সন্তান জায়রা। নাতনি মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো। মেয়ে তাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিল। ঘটনার দেড় ঘণ্টা পর জায়রাকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু আমার মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছিল না।
এ বাবা আরও বলেন, লামিয়ার আগুনে পোড়া এনআইডি কার্ড উত্তরার একজন ব্যক্তির কাছে পাই। ওই লোক বলেছিল, লামিয়াকে দগ্ধ অবস্থায় সেনাবাহিনীর এক অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওই সময় তার শরীর দগ্ধ অবস্থায় থাকলেও সে জীবিত ছিল। এরপর খুঁজেও তাকে পায়নি। গত বুধবার ডিএনএ টেস্টের জন্য রক্ত দিয়ে আসি।
বিমান ধ্বংসের ঘটনায় যথারীতি তদন্ত হচ্ছে। যান্ত্রিক ত্রুটি নাকি অন্য কিছু তদন্তে বেরিয়ে আসবে আশা করি।