১৬টি এফ-৭ যুদ্ধ বিমানের ৪টিই বিধ্বস্থ
হাসান মাহমুদ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:০৪ এএম, ২৬ জুলাই ২০২৫ শনিবার

# বিমানের বার্ধক্যজনিত যান্ত্রিক ত্রুটিই প্রধান কারণ!
# ৫.৬ মিলিয়ন ডলারে কেনা বিধ্বস্ত জেট
# যুদ্ধ বিমান খালেদার চুক্তি ও হাসিনার আমদানীকৃত
‘মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি’র পূর্ব ইতিহাস অত্যন্ত কদর্যপূর্ণ। চীনের কাছ থেকে কম দামে বিমান কিনে ইতোমধ্যে ৪টি বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ৪ জন পাইলটই এতে নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণি থেকে জানা যায়, চীনের কাছ থেকে ২০০৪-২০০৫ অর্থ বছরে করা একটি চুক্তির ফলে ১৬টি এফ-৭ ফাইটার জেট বাংলাদেশের তৎকালিন সরকার গ্রহণ করে। বিমানগুলি ২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ করেছে। সর্বশেষ চালানটি ২০১৩ সালে বাংলাদেশের হাতে আসে। ঐ বছরই চীনা কোম্পানি চেংডু এফ-৭ বিমান উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। যা উৎপাদন শুরু করেছিল ১৯৬৫ সালে। বিশ্ব বাজারে অনেকটা কম দামে কেনা এসব এফ-৭ যুদ্ধ বিমানের একটি ঢাকার মাইলস্টোন স্কুলে গত ২১ জুলাই দুপুরে বিধ্বস্ত হলে বিপর্যয় নেমে আসে। চারদিকে হাহাকার আর আর্তনাদ শুরু হয়। সরকার ৩১ জনের মৃত্যুর খবর দিলেও এখনো অনেকে নিখোঁজ। আগুনের পুড়ে দগ্ধ হয়েছে অন্তত ১৭০ জন। তৎকালিন সংসদে বিএনপি সরকারের পানি সম্পদমন্ত্রী ও সংসদ বিষয়ক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ৯৩.৬ মিলিয়ন ডলার দিয়ে চীনের কাছ থেকে ১৬টি যুদ্ধবিমান কিনবে বলে জাতীয় সংসদকে জানান। এসময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জিএম কাদেরের এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘চীনের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ২০০৪-০৫ অর্থবছরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। প্রতিটি উড়োজাহাজের জন্য ৫.৮৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে’। হাফিজ উদ্দিন সংসদে বলেন, ‘বিমান বাহিনীর জন্য যুদ্ধবিমান ক্রয় একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া’। তৎকালিন মন্ত্রী অবশ্য ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু আর সংসদকে জানাননি।
গত ২১ জুলাই ঢাকায় বিমান বিধ্বস্ত হবার পর চীনা চেংডু কোম্পানির শেয়ার বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবার ধস নেমেছে বলে জানা যায়। এফ-৭ যুদ্ধবিমানগুলি মূলত চীনের পুরনো নকশা, পুনরাবৃত্তি, প্রযুক্তিগত ত্রুটি এবং সুরক্ষাগত উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে। ১৯৬৫ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চীন এফ ৭ জেট বিমান তৈরি করতো রাশিয়ার মিগ ২১ এর অনুকরণে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পরে দুর্ঘটনাটি ঘটে। যেখানে পাইলট তার প্রথম একক মিশনে জেটটিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। ওই এলাকায় উড্ডয়নের আরেকটি কারণ হচ্ছে হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের একটি মাত্র রানওয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এবং বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন যৌথভাবে ব্যবহার করে। যুদ্ধবিমানগুলো যখন আকাশে টেক অফ করার প্রস্তুতি নেয় তখন ঢাকার আকাশে অপেক্ষমান বিভিন্ন দেশের যাত্রীবাহি বিমানগুলো উড়তে থাকে। জেট বিধ্বস্তের আগে পাইলট তৌকির মাইলস্টোন স্কুলের অতি কাছে বিমানবন্দরের রানওয়েতে এটিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু তার আগেই এটি স্কুলে ঢুকে যায়। বিধ্বস্ত হবার মুহূর্তে ‘ইজেক্ট করে’ পাইলট বের হয়ে আসেন। তিনি ছিটকে গিয়ে পড়েন স্কুলের প্রশাসনিক ভবনের একটি টিনের চালের ওপর। তাতে তিনি চাল ভেঙ্গে রুমের ভেতরে পড়ে আহত হন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মারা যান।
এফ-৭ বিজিআই জেটগুলি চীনের চেংডু এফ-৭ এর আপগ্রেড সংস্করণ, যা নিজেই সোভিয়েত-যুগের মিগ-২১ এর বিপরীত-ইঞ্জিনিয়ারড বৈকল্পিক, এমন একটি মডেল উৎপাদন ৪০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে ২০১৩ সালে চীন সমাপ্তি ঘোষনা করে। বাংলাদেশ ২০১৩ সালে এই বিমানগুলির শেষ ব্যাচটি হাতে পেয়েছিল। তবে বিমানটির নকশা মূলত আধুনিক মানের দিক থেকে একটি পুরানো প্ল্যাটফর্ম হিসাবে রয়ে যায়।
গত দুই দশকে বাংলাদেশের বিমান বাহিনীতে রেকর্ড করা ১১টি বিমান দুর্ঘটনার মধ্যে ৭টিতে এফ-৭ সিরিজের চীনা বিমান জড়িত ছিল। যা ক্রমাগত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দিয়ে আসছিল। তবে তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়ননি কর্তৃপক্ষ।
প্রথম একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ঢাকা থেকে ৮৩ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলে একটি গ্রামে বিধ্বস্ত হয়। যার ফলে এর পাইলট মোরশেদ হাসান নিহত হন। যুদ্ধ বিমানটির প্যারাস্যুট ঠিকমত কাজ করেনি বলে জানা যায়। ২০১৫ সালের জুন মাসে, আরেকটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বন্দর নগরী চট্টোগ্রামের কাছে বিধ্বস্ত হয়। পাইলট লেফট্যানেন্ট তাহমিদকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালের নভেম্বরে, টাঙ্গাইলে আরেকটি প্রশিক্ষণ সেশনের সময় এফ-৭ বিজি বিধ্বস্ত হয়। ঢাকা থেকে উড্ডয়নের মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যেই মাটিতে আছড়ে পড়লে ফুয়েল ট্যাঙ্কে আগুন ধরে যায়। পাইলট উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দীপু বেঁচে ফিরতে পারেননি।
এফ-৭ বিমানগুলি বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছিল। কারণ তাদের বার্ধক্য এবং যান্ত্রিকভাবে অবিশ্বস্ত প্রকৃতি, অনিরাপদ ঢাকা শহুরে ফ্লাইটের অবস্থার সাথে মিলিয়ে জীবনকে বিপন্ন করেছে।
বিএনপি সরকারের বিদায়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার রাশিয়ার কাছ থেকে ১২৩.৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান কিনেছিল যা ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলের সাংসদ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জমান এই ক্রয়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিলেন। অভিযোগগুলি ছিলঃ বিমানগুলি পুরনো ছিল এবং তাতে সরকারি তহবিলের অপব্যবহার করা হয়েছিল। চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে অগ্রিম অর্থ প্রদান করা হয়েছিল এবং ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব ছিল।
মামলাটি অনুসরণ করে, হাইকোর্ট সরকারের উপর একটি রুল নিশি জারি করে এবং কেন ক্রয় চুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করা উচিত হবে না তা ব্যাখ্যা করতে বলেন আদালত। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিমান কেনার বিষয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করে।
এভিয়েশন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম উল্লেখ করেন যে, এই ধরনের অপারেশনগুলি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে, যা সামরিক ও বাণিজ্যিক উভয় বিমান একই রানওয়ে থেকে পরিচালনা করা হয়। বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল প্রধান হাসান মাহমুদ খান বলেন, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঢাকায় ‘একটি শক্তিশালী বিমান ঘাঁটি’ থাকা অপরিহার্য এবং জনগণকে গুজবের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে দুর্বল না করার আহ্বান জানান তিনি।
ইউরোফাইটার বা জেএফ-১৭ জেট কেনার পরিকল্পনায় অগ্রগতি দেখা গেলেও বাংলাদেশের সীমিত বাজেট এবং জটিল ক্রয় প্রক্রিয়ার কারণে এফ-৭ কেনা হয়। ‘এফ-৭ বিজিআই’ হল এফ-৭ এর একটি আপগ্রেড সংস্করণ। চীনা-ডিজাইন করা সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগের মিগ-২১ মডেলে এটি করা হয়েছিল।
থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ইউরোপীয় শাখার প্রতিরক্ষা কৌশল, নীতি ও সক্ষমতার গবেষণা প্রধান জ্যাকব প্যারাকিলাস বলেন, ‘এটি একটি খুব পুরনো বিমানের তুলনামূলকভাবে নতুন সংস্করণ। সর্বশেষ এফ-৭ বিজিআই ২০১৩ সালে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। প্যারাকিলাস নিউজউইককে বলেন, এফ-৭ একটি ইন্টারসেপ্টর বিমান হিসাবে ডিজাইন করা হয়েছিল। মূল মডেলটি পুরনো হওয়ার বিষয়টি সহজাতভাবে এটিকে অনিরাপদ করে তোলে না।’
ইউ. কে. ভিত্তিক প্রতিরক্ষা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) অনুসাওে বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ১২টি এফ-৭ বিজিআই জেট, ১১টি এফ-৭ বিজি এবং ৭টি এফ-৭ এমবি বিমান রয়েছে। বাংলাদেশ সোভিয়েত যুগের হাতে গোনা কয়েকটি মিগ-২৯ বিমানও পরিচালনা করে।
এফ-৭ বিজিআইকে একটি বার্ধক্যজনিত প্ল্যাটফর্ম বলা হয়। একটি বাজেট-বান্ধব মাল্টিরোল বিমান হিসাবে বাজারজাত করা হয়েছে। সীমিত বাজেটের অনেক বিমান বাহিনীর জন্য, এফ-৭ বিজিআই-এর মতো বিমান প্রশিক্ষণের জন্য সাশ্রয় এবং কর্মক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বলে মনে করা হয়।