বিদেশি দায়দেনা পরিশোধে রেকর্ড
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:২২ এএম, ২০ জুলাই ২০২৫ রোববার

বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ বৃদ্ধির ফলে পরিশোধ হয়েছে রেকর্ড বিদেশি দায়। গত অর্থবছর শুধু সরকারি খাতে ৫৭০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি। এর বাইরে মেয়াদোত্তীর্ণ আমদানি দায় বাড়তে বাড়তে ৪৪ কোটি ৫৩ লাখ ডলারে উঠেছিল। বছর শেষে তা কমে ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে নেমেছে। এর আগে কোনো এক অর্থবছরে এত দায় পরিশোধ হয়নি। অর্থ পাচার কমে যাওয়ায় রেমিট্যান্স বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে দায় পরিশোধে উন্নতি হয়েছে। এত পরিশোধের পরও বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ বেড়ে জুন শেষে ৩১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। গত ২৮ মাসের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের সময়ে সবচেয়ে অস্বস্তি ছিল ডলার বাজারে। রেকর্ড মূল্যস্ফীতির মূলে ছিল ডলারের দর বৃদ্ধি। সংকটের কারণে বিদেশিদের কাছে বকেয়া বাড়ছিল। ভারতের আদানিসহ অনেকের সঙ্গে টানপোড়েন চলছিল। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে সরকার। এরপরই রেমিট্যান্স ব্যাপক বাড়ছে। গত অর্থবছর ব্যাংকিং চ্যানেলে রেকর্ড তিন হাজার ৩৩ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি। আবার রপ্তানি আয়ে ৯ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি রয়েছে। এর মধ্যে গত জুনে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ এসেছে। সব মিলিয়ে প্রতি ডলারে সাড়ে তিন টাকার মতো কমে আন্তঃব্যাংকে ১১৯ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে যায়। আকস্মিক দর পতন ঠেকাতে নিলামের মাধ্যমে গত সপ্তাহে বাজার থেকে ৪৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর আবার ১২১ টাকার ওপরে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সমকালকে বলেন, অর্থ পাচার ঠেকাতে এখন কঠোর তদারকি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রেমিট্যান্সে উচ্চপ্রবাহ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হয়েছে। আগের বকেয়া দায় পরিশোধের পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। আগামীতে এ ধারা বজায় থাকবে বলে আশা করা যায়।
যত পরিশোধ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশি দায়ের ৫৭০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার পরিশোধ হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৭৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে দেওয়া হয়েছে ৪৪৪ কোটি ২৫ লাখ ডলার। আর ভারতের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক দিয়েছে ১০১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বাকি ২৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে সোনালী ব্যাংক। ব্যাংক দুটির কাছে উদ্বৃত্ত ডলার থেকে এ দায় পরিশোধ হয়েছে, তেমন নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এ ডলার জোগাড় হয়।
রূপপুর প্রকল্পে পরিশোধ জটিলতা রয়ে গেছে
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ। সোনালী ব্যাংকে একটি ‘স্ক্রো’ হিসাব খুলে সেখানে অর্থ জমা রাখা হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছর এই হিসাবে আরও ২২ কোটি ২৯ লাখ ডলার জমা হয়েছে। সব মিলিয়ে জমার পরিমাণ ১০৩ কোটি ১৯ লাখ ডলারে ঠেকেছে। গত বছর চীনের মাধ্যমে এই অর্থ পরিশোধ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সরকার। এর বাইরে পায়রা বন্দরের কয়লা আমদানির জন্য রিজার্ভ থেকে দেওয়া হয়েছে ২৩ লাখ ২০ হাজার ডলার।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৬ সালের জুলাইতে রাশান ফেডারেশনের ‘এটমস্ট্রয় এক্সপোর্টে’র সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণ চুক্তি হয়। চুক্তিমূল্যের ৯০ শতাংশ বা ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার অর্থায়ন করছে রাশিয়া। বাকি ১০ শতাংশ সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে স্থানীয় ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। প্রকল্পের মূল ঋণ পরিশোধ শুরু হতে এখনও দেরি আছে। তবে ঋণের সুদ এবং প্রকল্প ঋণের বাইরে প্রাথমিক কাজের জন্য নেওয়া ৫০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের সময় শুরু হয়েছে ২০২৩ সালে। তবে রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
আমদানি বকেয়া কমে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার
শুধু সরকারি খাতে সরকারি পরিশোধ হয়েছে, তেমন নয়। পণ্য আমদানি করেও তা পরিশোধ না করার প্রবণতা ব্যাপক বাড়ছিল। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় মেয়াদোত্তীর্ণ আমদানি দায়ের পরিমাণ ছিল ৪৪ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর হুঁশিয়ারির পর তা কমে গত ডিসেম্বর শেষে ২০ কোটি ডলারে নেমেছিল। গত মার্চ শেষে নেমেছিল ১০ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে। এরপর জুন শেষে আরও কমে ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে নেমেছে। এসব বিলে এমন ত্রুটি বা মামলা রয়েছে, যে কারণে পরিশোধ করা যাচ্ছে না। আমদানি বিলের বকেয়া কমাতে গত ২০ এপ্রিল এক নির্দেশনার মাধ্যমে গ্রাহকের সম্মতি নিয়ে ক্রটিপূর্ণ আমদানি বিলের দায় পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।