শনিবার   ১৯ জুলাই ২০২৫   শ্রাবণ ৩ ১৪৩২   ২৩ মুহররম ১৪৪৭

আগুন নিয়ে খেলছেন ইউনূস!

মনোয়ারুল ইসলাম, নিউইয়র্ক/ মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৫৮ এএম, ১৯ জুলাই ২০২৫ শনিবার


          

বাংলাদেশে অর্ন্তবর্তি সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে কঠিন এক অগ্নিপরীক্ষা। ক্ষমতার আগুন নিয়ে খেলছেন তিনি। যে আগুনে পুড়ে হাসিনা দেশান্তরিত। ভারতে নির্বাসিত।  জিয়া পুত্র তারেক যুক্তরাজ্যে পরবাসী। ২ জনই ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন। ইউনূস চাকুরিদাতা সোনার ছেলেদেরও ক্ষমতার মসনদে দেখতে অতি উৎসাহী। তাদের এনসিপিকে কিংস পার্টি বানিয়ে রেখেছেন। পুলিশ, আর্মি ও প্রশাসন ছাড়া তাদের শক্তিমত্তা শুন্যের কোঠায়। জামায়াত স্বপ্ন বিলাসে। এদের হাতেই ক্ষমতার আগুন হস্তান্তর করতে হবে। আর ব্যর্থ হলে তাকেই এ আগুনে পুড়তে হবে। সে আগুনের তাপাদোহ বাড়তে পারে উত্তরপাড়া টু যমুনা। কিংবা দিল্লী টু ঢাকায়। সমালোচকরা বলছেন, ৩৬ জুলাই আন্দোলনে সোনার ছেলেদের সহায়তায় রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ইউনূস আজ সরকার প্রধান। তাদের আগুনেই পুড়তে হবে ইউনূসকে। গোপালগঞ্জের ঘটনা ভিন্ন বার্তা বহন করে। ট্যাংকের গুহায় আশ্রয় নিয়ে হাসনাত- নাহিদদের প্রাণ রক্ষা সরকারের প্রাণ রক্ষার সমতুল্য। হাসনাতদের বডি ল্যাংগুয়েজ ও চোখ রাংগানোর রাজনীতি ও বাস্তবতা ভিন্নমুখি। কথাটি পরিষ্কার। একটি অবাধ, সুষ্ঠু  ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আকাংখাকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র অব্যাহত। এনসিপি কোনভাবেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের পক্ষে নয়। তারা ষড়যন্ত্রের পথে পা রাখছেন এমন অভিযোগও উঠছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি লন্ডন ও ওয়াশিংটনে। অথচ ডক্টরের শিষ্য নাহিদ বৃহস্পতিবার বললেন, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়। সোহাগ হত্যাকান্ড ও গোপালগঞ্জ ঘটনা অন্ধকার টানেলের প্রবেশ পথে। কেউ কেউ বলছেন, মেটিকুলাস ষড়যন্ত্র। উদ্দেশ্য একটাই, নির্বাচনী ট্রেনকে লাইনচ্যুত করা। নোবেল বিজয়ী এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বকে নিজের প্রতিশ্রুতির সঙ্গেই লড়াই করতে হচ্ছে। তিনি বাংলাদেশে এমন নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছেন যা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে। কিন্তু দ্বিদলীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ। অন্তত ২০ শতাংশ ভোটার দলটির সমর্থক। এই দলের অংশগ্রহণ বাদ রেখে বাংলাদেশে প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ নির্বাচন কীভাবে সম্ভব - এমন প্রশ্ন সামনে আসছে। কিন্তু অর্থপূর্ণ অর্ন্তভুক্তিমূলক নির্বাচনের স্বার্থে বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ভোটের মাঠে নিয়ে আসাও বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। ফলে সামনে একটি একতরফা নির্বাচনের হাতছানি। কারণ মাঠে বিএনপি এখন একক শক্তিশালী দল। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ফেব্রুয়ারি কিংবা এপ্রিলে নির্বাচন করার অঙ্গীকার করেছেন ইউনূস। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর কাছেও দ্রুততম সময়ে নির্বাচন করার কথা বলেছেন তিনি। ফলে ভোটের চিত্র কেমন হবে সেটি বিবেচ্য।
জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী দলগুলো একটি জোট করলে সেটিই সম্ভাব্য বিরোধী দলের আসনে বসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই ধরনের বিরোধী দল হবে খুবই দুর্বল। অর্ন্তবর্তি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) সারাদেশে শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলতে পারেনি। দলটির নেতারা যথেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পন্ন নন। ফলে তাদের পক্ষে হটকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অসম্ভব নয়। সম্প্রতি শেখ হাসিনার শক্তিশালী ঘাঁটি গোপালগঞ্জে যাওয়ার পর যে ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেছে তা রীতিমত একবছর আগে সারাদেশে সৃষ্ট উত্তাল পরিস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার ভেঙ্গে ফেলা হবে বলে গুজব ছড়ানোর পর গোপালগঞ্জ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী গুলিবর্ষন করলে কমপক্ষে চারজন মারা যান। সেখানে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ চলছে। এই মূহুর্তে গোপালগঞ্জ যাওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক ছিলো সেটা অর্ন্তবর্তি সরকারে থাকা তাদের মুরুব্বীরা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, গোপালগঞ্জে গোলযোগ হবার গোয়েন্দা তথ্য থাকলেও পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হবে বলে তারা ধারণা করতে পারেননি।
বর্তমান ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে সেই প্রশ্নের কোনও সুরাহা হয়নি। সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশের প্রেক্ষিতে কতটা প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে তা নিয়ে সংশয় কাটেনি। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মক খারাপ। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পুলিশ খুবই অসংগঠিত। এসব নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে এই পুলিশ বাহিনী নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা উন্নত রাখতে কতটা সক্ষমতা অর্জন করেছে এই প্রশ্ন রয়েছে।
অর্ন্তবর্তি সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকটাও বিবেচনা করা দরকার। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে অর্ন্তবর্তি সরকারের সম্পর্ক খুবই খারাপ। গত বছর ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ফলে তিনি সেখানে থেকে রাজনৈতিক যোগাযোগ রাখছেন। ভারতও বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউনূসের সরকারের সম্পর্ক ভাল হতে পারে বলে সাধারন মানুষের ধারণা ছিলো। কিন্তু সম্প্রতি শুরু হওয়ার শুল্ক আলোচনায় তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক ঘোষণা করে এপ্রিলে। ওই সময়ে বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটি বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রে মূলত বাংলাদেশের পোশাক রফতানি করা হয়ে থাকে। পোশাক শিল্পে এমনিতেই ১৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। নতুন শুল্ক আরোপ হলে বাংলাদেশের পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমে যাবে। তখন প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ট্রাম্পকে চিঠি দিয়ে নতুন শুল্কের কার্যকারিতে তিন মাস পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। বিশ্বের সকল দেশের জন্যেই ট্রাম্প ৯ জুলাই পর্যন্ত নতুন শুল্ক কার্যকর করার সময় বৃদ্ধি করেন। ওই সময়ে আলোচনা করে ভিয়েতনাম ৪৬ শতাংশ শুল্ক থেকে তা ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। ভিয়েতনাম বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্ধী দেশ। অপরদিকে, বাংলাদেশ আলোচনা করে ৩৭ শতাংশ থেকে মাত্র দুই শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণে সক্ষম হয়। ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বের দেশগুলোর জন্য পহেলা আগস্ট থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ দ্বিতীয় দফা আলোচনা থেকেও তেমন সুফল পায়নি। বাংলাদেশ থেকে সাত বিলিয়ন ডলারের পণ্য প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আমদানি এক বিলিয়ন ডলারের মতো। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, গম, বোয়িং এয়ারক্রাফ্ট, সয়াবিন, জ¦ালানী তেল আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করতে হবে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের অধিকার পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবে আলোচনা আটকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে কী ধরনের নিরাপত্তা সহযোগিতা চায় সেটা প্রকাশ করেনি কোনও দেশই। বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এই বিষয়ে ফের আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে আছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কমানোর অদৃশ্য চাপ থাকবে। ইউনূসের সামনে এটাও একটা বড় পরীক্ষা। এই রকমের হাজারো চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য, অর্ন্তভুক্তিমূলক নির্বাচন করে ইতিহাস সৃষ্টির হাতছানি ইউনূসের সামনে। তিনি এই বিশাল ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিতে কতটা সক্ষম হবেন সেটা জানার অপেক্ষায় সবাই।