শনিবার   ১২ জুলাই ২০২৫   আষাঢ় ২৭ ১৪৩২   ১৬ মুহররম ১৪৪৭

শেখ হাসিনার পুলিশ প্রধান সেনাপতিই রাজসাক্ষী!

আজকাল প্রতিনিধি, ঢাকা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:০৩ এএম, ১২ জুলাই ২০২৫ শনিবার


 

জুলাই অভ্যূত্থানে হত্যাযজ্ঞের বিচার শুরু হয়েছে। আসামী তিনজন। শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং ওই সময়ের পুলিশ প্রধান আব্দুল্লাহ আল মামুন। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুনের মন্তব্যে সবার চোখ ছানাবড়া। ‘আই ফিল গিল্টি’। নিজের দোষ স্বীকার করে নিলেন। শুধু তাই নয়; শেখ হাসিনার নির্দেশে সকল নিষ্ঠুরতা পরিচালনা করলেও এখন তারই বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে প্রধান সেনাপতি তথা আইজিপি আবেদন করলেন। যেহেতু জুলাই আন্দোলনের সময়ে সকল দমন-পীড়ন আব্দুল্লাহ আল মামুনের কমান্ডে হয়েছে। অতএব শেখ হাসিনার প্রধান সেনাপতি তিনিই ছিলেন একথা বলা যায়। এখন তিনি পক্ষ ত্যাগ করলেন। তবে তার হাতে সকল নথি, আলামত এবং ঘটনার চিত্র রয়েছে। তিনি যদি এগুলো ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন তবে বিচারে অনেক প্রমাণ মিলবে। এই বিবেচনায় আব্দুল্লাহ আল মামুন অনেক অজানা কথার নীরব দর্শক ছিলেন। তাই তাকে রাজসাক্ষী করার মাধ্যমে বিচার কাজ শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনার জন্যে আরেকটি ট্র্যাজেডি হলো, যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য তিনি এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। এখন সেখানে তারই বিচার হচ্ছে। শেখ হাসিনার একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হবার পর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অডিওতে ‘লেথাল উইডন ব্যবহার করো। সবাইকে গুলি করো’। এসব ডায়লগ আছে। এগুলোকে হত্যার নির্দেশ বলে আদালতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিচার শুরুর একদিন আগে বিবিসি এক প্রতিবেদনে অডিও রেকর্ড শোনায়। বিবিসি’র স্টোরিতে বলা হয়, রেকর্ডটি সঠিক কিনা তা যাচাই করার পর তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এই অডিও রেকর্ড সঠিক। এটি শেখ হাসিনারই কন্ঠস্বর।
বিবিসি’র ফাঁস করা রেকর্ড সম্পর্কে শেখ হাসিনার কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাজিক মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কোনও কোনও মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এটা তৈরী করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার সময়ের নির্দেশ এটা। তবে বিবিসি বলছে, জুলাই জাগরণের উত্তাল দিনগুলোর সময় যাত্রাবাড়িতে ৫২ জন আন্দোলনকারী গুলিতে নিহত হন। ওই সময়ে শেখ হাসিনার নির্দেশে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। নির্দেশের পর এতবড় হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে।
রাজসাক্ষী হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের বিচারে আবদুল¬াহ আল-মামুন কি দায় থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, নাকি তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে- এ নিয়ে বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, আসামি চৌধুরী আবদুল¬াহ আল-মামুনের বক্তব্যের মাধ্যমে পুরোপুরি সত্য প্রকাশিত হলে আদালত তাকে ক্ষমা করতে পারেন। অথবা অন্য কোনো আদেশও দিতে পারেন।
ট্রাইব্যুনাল আইনে বলা হয়েছে, ঘটনার মূল হোতা বা সহায়তাকারীকে সেটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত (রাজসাক্ষী) ব্যক্তি সাক্ষ্য গ্রহণে সত্য ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ করার শর্তে ক্ষমা পেতে পারেন। তবে শর্ত থাকে যে, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরূপ ব্যক্তিকে আটক রাখতে হবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, চৌধুরী আবদুল¬াহ আল-মামুন  ‘রাজসাক্ষী’ । আইনের পরিভাষায় ‘একটি অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা সে সম্পর্কে গোপন তথ্যের অধিকারী কোনো ব্যক্তি যদি ক্ষমা পাওয়ার শর্তে অপরাধের সমগ্র ঘটনা, মূল অপরাধী ও সহায়তাকারী হিসাবে জড়িত সব অপরাধী সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও সত্য ঘটনা প্রকাশ করে আদালতে যে সাক্ষ্য প্রদান করে, তখন তাকে ‘রাজসাক্ষী বলে’। রাজসাক্ষী হওয়ার বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ধারা, সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় উলে¬খ রয়েছে। সাক্ষ্য আইন প্রণয়নের সময় যেহেতু রাজার শাসন ছিল, তাই এই ধরনের সাক্ষীকে রাজসাক্ষী বলা হয় এখনও। এখন রাজসাক্ষীকে রাষ্ট্রের সাক্ষী বলে অভিহিত করেন কেউ কেউ। আসামি হলেও আদালতকে সহায়তা করায় রাজসাক্ষীর শাস্তি কম পাওয়া কিংবা ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ থাকে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন-১৯৭৩-এর ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিচারের যে কোনো পর্যায়ে ট্রাইবুনাল ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা ধারা-৩ এ উলে¬খিত অপরাধের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণের উদ্দেশ্যে এরূপ ব্যক্তিকে এই শর্তে ক্ষমা করতে পারেন যে, সে ঘটনার মূল হোতা বা সহায়তাকারী হিসেবে সে যা জানে তার পূর্ণ ও সত্য ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ করবে। (২). বিচারে এরূপ প্রস্তাব গ্রহণকারী ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে পরীক্ষা করা হবে। (৩). বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরূপ ব্যক্তিকে কারাগারে আটক রাখতে হবে।’
প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেছেন, শর্ত মোতাবেক রাজসাক্ষী যদি সাক্ষ্য দেন, তাহলে ট্রাইব্যুনাল যে কোনো শাস্তি দিয়ে আবার ক্ষমা করে দিতে পারেন। প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ বলেন, আইন অনুযায়ী কোনো রাজসাক্ষী যদি সব শর্ত পূরণ করে, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন ট্রাইব্যুনাল। এই ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। এটা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।