মামদানি-শাহানার ভূমিধস বিজয়
হাসান মাহমুদ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:১৯ এএম, ২৮ জুন ২০২৫ শনিবার

বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আনন্দের বন্যা
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র প্রার্থী জোহরান খাওমি মামদানি (৩৩) ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে এক বিস্ময়কর রেকর্ড গড়লেন। তিনি তাঁর অন্যতম প্রভাবশালী প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী এন্ড্রু কুমোকে ধরাশায়ি করেছেন। সারা সিটিতে গত মঙ্গলবার রাত ১০টা বাজার সাথে সাথে মামদানির বিজয় সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এ সময় আনন্দ উল্লাসে অংশ নিতে মানুষ ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়ে আসেন। গভীর রাত পর্যন্ত মামদানি সমর্থকদের বিজয়ের আনন্দে মেতে থাকতে দেখা যায়। একই বিজয়ের সুবাতাস বয়ে যায় ব্রুকলিনেও। দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন কাউন্সিল মেম্বার বাংলাদেশি শাহানা হানিফ। মামদানি ও শাহানার এই ভূমিধস বিজয় প্রত্যক্ষ করলো লাখ লাখ মানুষ। বাঙালি কমিউনিটির পক্ষ থেকে তাদের জন্য ছিল জোরালো সমর্থন আর ভালোবাসার অর্ঘ্য। নিউইয়র্কে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মুসলিম মেয়র প্রার্থী মামদানি প্রাইমারিতে বিজয়ি হলে তার স্ত্রী রামা ডোওয়াজি তাঁকে প্রথম অভিনন্দন জানান। তারপর রাতেই পরাজিত প্রার্থী এন্ড্রু কুমো, বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস মামদানিকে অভিনন্দন জানিয়ে ফোন করেন। চারদিকে মামদানির জোয়ার আর বিজয় ধ্বনি মঙ্গলবার রাতের পরিবেশকে উজ্জ্বল করে তোলে। মূলধারার মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়ায় মামদানির বিজয়ের সংবাদ ছিল শীর্ষে। অনেকের কাছে এ বিজয় ছিল বিস্ময়ের। কুমো শিবিরে মামদানির অবিস্মরণিয় এই বিজয়ে মলিন হয়ে যায় তাদের সবকিছু। কাঙ্খিত বিজয়ে কুইন্সের এস্টোরিয়ার ২৯-১৯ টুয়েন্টি ফোর্থ এভিনিউর পার্টি সেন্টারে মামদানির সমর্থকরা আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেন। মামদানি বাঙালি কমিউনিটির কথা বারবার বিজয় ভাষণে উল্লেখ করেছেন। জ্যাকসন হাইটস এলাকার ৭৪ স্ট্রিটের একটি রেস্টুরেন্টে তাকে নিয়ে আয়োজকদের নির্বাচনি কর্মযজ্ঞ ছিল চোখে পড়ার মতো। জ্যামাইকার ১৬৮ স্ট্রিটে মামদানির সমর্থকরা বিজয়ের সংবাদে মাতোয়ারা ছিলেন। এ সময় তারা মিষ্টি বিতরণ করেন। ব্রুকলিনেও মামদানি সমর্থকরা কুমোর পরাজিত সংবাদে ছিলেন উল্লসিত। ব্রংকসের পার্কচেষ্টারে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২৫ জুন বিকেলে বিজয় মিছিল বের করে। এতে অংশ নেয় ব্রংকস কমিউিনিটি কাউন্সিল,বাংলাদেশি আমেরিকান কমিউনিটি কাউন্সিল,দ্যা মুসলিম এন্ড আমেরিকান কোয়ালিশন ফর জাস্টিস, ব্রংকস বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ও বাংলাদেশি কমিউনিটি অব নর্থ ব্রংকস নেতৃবৃন্দ। আয়োজকদেও মধ্যে ছিলেন মনজুর চৌধুরী, এমএন মজুমদার,সাব্বির গুল,শেখ হামিদ,মামুন ইসলাম ইব্রাহিম বারো ভূইয়া ও মোহাম্মদ আলাউদ্দীন। জোহরান মামদানি ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মা মীরা নেয়ার একজন ভারতীয়, বাবা উগান্ডার নাগরিক মাহমুদ মামদানি। জোহরান মামদানি ব্রঙ্কস এলাকায় বেড়ে উঠেন। মামদানির স্ত্রী সিরিয়ার নাগরিক। মামদানি ৪৩.৫১%, কুমো ৩৬.৪২%, ব্র্যাড ল্যান্ডার ১১.৩১ % ভোট অর্জন করেন।
নির্বাচনি ফলাফল জানতে পেরে রাতেই কুইন্সের কয়েকটি স্থানে বিজয় সমাবেশে মামদানি তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে আবেগজড়িত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক নিউইয়র্কবাসীর জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছি। আজ আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। মেয়র নির্বাচনে এখন আমিই আপনাদের ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী। আপনারা আমাকে অথবা গভর্নর কুমোকে ভোট দিয়ে থাকুন না কেন, অথবা আমাদের দীর্ঘকাল ধরে ভেঙে পড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে ভোটদানে অনাগ্রহী হয়ে থাকুন না কেন, আমি এমন একটি সিটির জন্য কাজ করবো, যে সিটি আপনাদের সবার জন্য কাজ করবে। আমি এমন কথা বলতে পারি না যে, আমার সঙ্গে আপনাদের সবসময় একমত পোষণ করতে হবে, তবে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি যে, আমি আপনাদের কাছ থেকে কোনোকিছু আড়াল করবো না।’
এসময় তার সমর্থকরা স্লোগানের মুখরিত করে রাখে চারদিক। মামদানি আরো বলেন, মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাত্রার অধিকার কেবলমাত্র কিছু ভাগ্যবান লোকের জন্য সংরক্ষিত করা কোনোভাবেই সঙ্গত নয়। নিউইয়র্ক সিটি এমন একটি সিটি হওয়া উচিত যেখানে স্থানীয় সরকার প্রতিটি নিউইয়র্কবাসীর জন্য উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দান করে। তিনি অবৈধ ইমিগ্রান্টদের আটক ও ডিপোর্ট করা সম্পর্কে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন- আমাদের প্রতিবেশীদের ডিপোর্ট করার অভিযানে নিয়োজিত মুখোশ পরা ‘আইস’ এজেন্টদের তৎপরতা বন্ধ করতে তার ক্ষমতা কাজে লাগাবেন’।
২৪ জুন প্রায় মধ্যরাতে ফলাফল ঘোষণার পর নিউইয়র্ক সিটিতে হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি জাকসন হাইটস, এস্টোরিয়া, ব্রংকসের পার্কচেষ্টার, ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড ও জ্যামাইকা এলাকায় আনন্দ মিছিল বের করে। আগামী ৫ নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে মামদানীকে লড়তে হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস ও রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়ার বিরুদ্ধে। রিপাবলিক্যান প্রার্থী তুলনামূলক অনেক দুর্বল। মুসলিম প্রার্থীকে ঠেকাতে রিপাবলিকান ভোটাররা এরিক অ্যাডামসকে সমর্থন দিতে পারে এমন ধারণা করা হচ্ছে। সাধারণত যিনিই ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে জয়লাভ করেন- ধরে নেয়া হয় ভবিষ্যৎ মেয়র হিসেবে তিনিই বিজয়ি হবেন।
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হওয়ার অর্থ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহত্তম ও ব্যস্ততম শহরের প্রধান নির্বাহী। মেয়র নির্বাচিত হলে মামদানিকে অনেক সমস্যা ও জরুরি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আবাসন, দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তা, মাদক সমস্যা, জীবনযাত্রার ব্যয়, যানজট ও গণপরিবহন অন্যতম। প্রতিবছর এই শহরে ভ্রমণে আসা প্রায় ৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষের ওপরেও এ নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব পড়বে। নিউইয়র্কের মেয়র বিশ্বজুড়ে পরিচিত একজন হয়ে উঠেন।
প্রাইমারিতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আরও প্রার্থী ছিলেন। তারা হলেন, সিটি কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডার, নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের স্পিকার অ্যাড্রিয়েন অ্যাডামস, সাবেক কম্পট্রোলার স্কট স্ট্রিঙ্গার, অঙ্গরাজ্যের সিনেট সদস্য জেসিকা রামোস, অঙ্গরাজ্যের সিনেট সদস্য জেলনার মাইরি, রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও অঙ্গরাজ্যের সাবেক আইনপ্রণেতা মাইকেল ব্লেক এবং বিনিয়োগকারী হুইটনি টিলসন।
চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষিত হওয়ার আগেই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কুমো পরাজয় মেনে নিয়ে মামদানিকে অভিনন্দন জানান। র্যাংকিং চয়েসের ভিত্তিতে ৫০% শতাংশ ভোট পেলে তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চূড়ান্ত প্রার্থিতা লাভ করবেন এবং চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষিত হবে আগামী ১ এপ্রিল।
গত মঙ্গলবার রাতে বিজয় ভাষণে মামদানি আরও বলেন, ‘আমি তাদেরই একজন, আমি আমার বিশ্বাস বা আমার প্রতিশ্রুতিগুলো ত্যাগ করব না। কিন্তু সমতার দাবিতে, মানবতার স্বার্থে যারা এই পৃথিবীতে কাজ করেন, আমি তাদের সকলের জন্য কাজ করতে, তাদের আরো কাছে পৌঁছতে সচেষ্ট থাকবো। এমনকি যাদের সাথে আমি একমত পোষণ করি না, আমি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে এবং মতবিরোধের উপসংহারে পৌঁছতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো’।